শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভয়ংকর ইউরোপ যাত্রা

কয়েক দফায় মানুষ বিক্রি করে পাচারকারী চক্র

আপডেট : ০২ জুন ২০২০, ০৫:৪৯

ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানব পাচারে বহু বছর ধরে লিবিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে পাচারকারী চক্র। লিবিয়া থেকে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি বা অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে কয়েক স্তরে কাজ করে চক্রটি। এই চক্রগুলোর সঙ্গে সুদান, মিসর, লিবিয়াসহ নানা দেশের লোক জড়িত।

প্রতিটি স্তরেই পাচারকারীদের এক চক্রের হাত থেকে অবৈধ অভিবাসীদের দলগুলোকে আরেক চক্রের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এভাবে ভাগ্যের অন্বেষণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বপ্নের দেশে যেতে আগ্রহী অবৈধ অভিবাসীরা তিন থেকে চার দফায় কেনাবেচার শিকার হন। বাংলাদেশে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রামরু’ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, লিবিয়ায় মানব পাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি চক্রের সরাসরি যোগসাজশ থাকে লিবিয়ায় বসবাসকারী চক্রের সঙ্গে। এই দালাল চক্র মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ আরো কয়েকটি জেলায় বেশি সক্রিয়। ঢাকায় চক্রটির নেতৃত্ব দেন লিবিয়ার কয়েক নাগরিক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থা যাতে সন্দেহ করতে না পারে, সেজন্য লিবিয়ার এই নাগরিকদের কেউ কেউ বছর জুড়ে অবস্থান করেন পাঁচতারকা হোটেলে। তবে লিবিয়ার এই নাগরিকদের কেউ কেউ একাধিকবার গোয়েন্দা সংস্থার হাতে ধরাও পড়েছেন। চক্রটির সঙ্গে জড়িত স্থানীয়দের কেউ কেউ রাজধানীর ফকিরাপুলে রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস খুলেছেন।

এই চক্রের মাধ্যমেই লিবিয়ায় গিয়ে দেশটির মিজদা শহরে বৃহস্পতিবার মানব পাচারকারীদের হাতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত ও ১২ জন আহত হন। জিম্মিকারী দালাল চক্রকে বাংলাদেশ থেকে দফায়-দফায় লাখ লাখ টাকা পাঠিয়েও স্বজনদের বাঁচাতে পারেনি ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে জিম্মিকারী দালাল চক্রের হাতে বন্দি হন মাদারীপুরের ২৬ বছরের যুবক শাহিন মাতুব্বর। এরপর কয়েক দফায় দেশে ফোন করে জিম্মিকারীরা মুক্তিপণ চেয়ে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। সুদে ঋণ করে টাকা পাঠিয়েও ছেলেকে বাঁচাতে না পেরে এখন দিশেহারা তার পরিবার।

বৃহস্পতিবার হত্যার শিকার ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে শাহিন মাতুব্বরও একজন। শাহিনের ভ্যানচালক বাবা কালাম মাতুব্বরের অভিযোগ, মাদারীপুরের রাজৈরের পাঠানকান্দি এলাকার লিবিয়া প্রবাসী আমির হোসেন এবং দেশে তার ভাই নূর হোসেনের মাধ্যমে সাত মাস আগে ছেলেকে লিবিয়ায় পাঠান। এরপর থেকে তাদের কাছে মোবাইলে শাহিনকে নির্যাতন করা হচ্ছে বলে লিবিয়া থেকে ফোন করে একাধিক ব্যক্তি। বাধ্য হয়ে সুদে ঋণ করে দুই দফায় ১০ লাখ টাকা দালালদের নির্দেশনা মতো দেন। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা ও ১১ জনকে আহত করার ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে ইতিমধ্যে ত্রিপোলির সরকারকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মানব পাচারকারী চক্র উন্নত জীবন ও বিপুল আয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে হতভাগ্য মানুষদের বিদেশে নিয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে এই দালাল চক্রের সঙ্গে প্রশাসনের লোকজনও জড়িত থাকেন।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো মোহাম্মাদ শহীদুল হক গণমাধ্যমকে জানান, ২০১৫ সালে এ ধরনের ঘটনা বেড়ে গেলে লোক পাঠানো বন্ধ করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেওয়া নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করা হয়। তখন স্থানীয় রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেন, বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তাদের। তবে বাংলাদেশ সরকার এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। ফলে হাইকোর্ট সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে সিদ্ধান্ত দেয়।

লিবিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে ইউরোপে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভুক্তভোগীরা জানান, স্থানীয় দালাল চক্র প্রথমে টোপ ফেলে প্রলোভন দেখিয়ে বলে, আগে টাকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই, ইতালি পৌঁছে তার পরে টাকাপয়সার লেনদেন হবে। কিন্তু বাংলাদেশ ত্যাগের পরে তাদের তিন থেকে চারবার বিক্রি করা হয়। তাদের লিবিয়া বা অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে জিম্মি করা হয়। পরে তাদের পরিবারের কাছে টাকা দাবি করা হয়।

রামরু ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইএমও সূত্রে জানা গেছে, গাদ্দাফি-পরবর্তী গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত লিবিয়ার অর্থনীতি কার্যত তেলনির্ভর। কাজের সন্ধানে এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ থেকেই তরুণরা অবৈধ পথে দেশটিতে পাড়ি জমায়। একপর্যায়ে তাদের বেশির ভাগেরই লক্ষ্য থাকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপের কোনো দেশে যাওয়া। এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে পুরো রুটে মানব পাচারকারী বিশাল চক্র সক্রিয় রয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশিরা মানব পাচারকারীদের সহায়তায় নানা দেশ ঘুরে লিবিয়া পৌঁছাচ্ছে। সেখান থেকে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সমুদ্রে নৌকা ডুবে বহুসংখ্যক বাংলাদেশির মৃত্যু হলেও ঝুঁকিপূর্ণ এই প্রবণতা বন্ধ হয়নি।

‘রামরু’র প্রধান তাসনিম সিদ্দিকী জানান, শুধু বাংলাদেশিদের কাছে নয়, এশিয়া ও আফ্রিকার আরো বহু দেশের অবৈধ অভিবাসীদের জন্য লিবিয়া ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠেছে। ২০০০ সালের দিকে ইংল্যান্ডে অবৈধ অভিবাসীদের ধরপাকড় শুরু হলে তাদের অনেকেই স্পেন ও ইতালি চলে যান। অন্যদিকে, লিবিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ২০০৮ সালের দিকে প্রচুর বাংলাদেশি লিবিয়ায় কাজের জন্য যেতে শুরু করেন। তখনই ইতালিতে থাকা বাংলাদেশিরা তাদের আত্মীয়স্বজনকে সেখানে নিয়ে যেত অথবা টাকার বিনিময়ে ইউরোপে লোকজন নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করতে শুরু করেন। এ সময়েই তারা লিবিয়াকে একটা রুট হিসেবে বেছে নেন।

ইত্তেফাক/এমআর