বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মাছ মাংসে বিষ, প্রমাণ মিলেছে

আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:০০

মাছ, পশু ও হাঁস-মুরগির যে খাবার দেয়া হয় তা উত্পাদন হচ্ছে চামড়া শিল্পের বর্জ্য দিয়ে। এসব বর্জ্যে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব মাছ, মুরগি ও পশু রান্না করলেও এই ক্রোমিয়াম নষ্ট হয় না। এর তাপ সহনীয় ক্ষমতা ২৯০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আর রান্না করা হয়ে থাকে ১০০-১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে তাপে।

ফলে এই বিষাক্ত ক্রোমিয়াম মানবদেহে প্রবেশ করে স্থায়ীভাবে কিডনি বিকল, লিভার অকেজো, মস্তিষ্কসহ শরীরের এমন কোন অঙ্গপ্রতঙ্গ নেই যার ক্ষতি করে না। এছাড়া এই বিষাক্ত ক্রোমিয়াম দেহের কোষ নষ্ট করে দেয় যা পরবর্তীতে ক্যান্সার সৃষ্টি করে।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০০ গ্রাম মুরগির মাংসে ক্রোমিয়াম আছে ৩৫০ মাইক্রোগ্রাম। হাড়ে ২০০০, কলিজায় ৬১২, মগজে ৪,৫২০ ও রক্তে ৭৯০ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম।

একজন মানুষের শরীর ৩৫ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম গ্রহণ করতে পারে। এর বেশি হলে তা দেহের জন্য ক্ষতিকর। একজন মানুষ যদি ২৫০ গ্রাম ওজনের এক টুকরা মাংস খায় তবে দেহে প্রবেশ করে ৮৭.৫ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম যা অনেক বেশি। যদি ৬০ গ্রাম ওজনের মাংসের টুকরো খাওয়া হয় তবে তা থেকে ২১.৮৮ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম শরীরে প্রবেশ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবন রক্ষায় বিষাক্ত ফার্মের মুরগি খাওয়া থেকে বিরত থাকা

উচিত। অনেকেই বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খেতে যান। আর বাচ্চাদের পছন্দই থাকে চিকেন ফ্রাই, গ্রিল, তান্দুরিসহ মুরগির নানা উপাদান। যা বেশিরভাগ সময় ফার্মের মুরগির হয়ে থাকে।

প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ ও কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হারুনুর রশীদ বলেন, সম্প্রতি কিডনি রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। কিডনি নষ্ট করার অন্যতম প্রধান কারণ ক্রোমিয়াম।

সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত বলেন, ক্রোমিয়াম এমন এক হেভিমেটাল যা মানবদেহে দ্রুত ক্যান্সার তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দ্রুত কিডনি ও লিভার নষ্টের ক্ষেত্রেও একই ভূমিকা পালন করে। রক্তেও নানান ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। মোট কথায়, শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রতঙ্গের ক্ষতি করে ক্রোমিয়াম। এই ক্রোমিয়ামযুক্ত খাবার যদি মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়, ওই পানি যদি মানুষ ব্যবহার করে, তাহলেও মানবদেহে একইভাবে সমস্যায় পড়তে হবে। ওই পুকুরের পানি যদি ফসলি জমিতে দেওয়া হয়, ফসলের শিকড় দিয়ে ফসলের দানায় চলে যাবে, তাহলে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করবে ক্রোমিয়াম। এটা পরীক্ষায় প্রমাণিত।

অতি সম্প্রতি সায়েন্স ল্যাবরেটরির সহযোগিতায় বুড়িগঙ্গা নদীর কামরাঙ্গীর চর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ৭ জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তার নেতৃত্বে পরীক্ষা করা হয়। তবে ওই পানিতে ক্রোমিয়ামের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। কারণ হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করার কারণে বুড়িগঙ্গায় এই সফলতা এসেছে।

এদিকে ক্রোমিয়ামযুক্ত মাছ-পশু-পাখি খাদ্য উত্পাদনকারী ১৫টি নামিদামি প্রতিষ্ঠানের তালিকা র্যাবের হাতে রয়েছে। ওই কোম্পানিগুলো হাজারীবাগ ও সাভার থেকে ট্যানারির বর্জ্যে তৈরি মাছ ও পশু-পাখির খাবার কিনে নিয়ে যাচ্ছে। অধিক মুনাফার লোভে বিষাক্ত খাবার খাওয়া মাছ-মুরগি মানুষকে খাইয়ে নিরবে হত্যা করছে। র্যাবের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে আসছে।

শিগগিরই র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলমের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করা হবে। মঙ্গলবার সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নে বিষাক্ত ট্যানারি দিয়ে তৈরি হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য উত্পাদনকারী ৫টি কারখানায় তার নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ১২ হাজার ৪৫ টন বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য দিয়ে তৈরি হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য জব্দ করা হয়। এতে জড়িত কোম্পানির মালিকসহ ১৫ জনকে কারাদন্ড ও জরিমানা করা হয়েছে। এর আগে হাজারীবাগে ৪টি বিষাক্ত খাদ্য উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছিল।

মূলত: ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম বলতে ‘হেক্সাভেলেনট ক্রোমিয়াম’ বা ‘ক্রোমিয়াম-৬’ বোঝায়। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা ক্রোমিয়াম-৬ কে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ হিসাবে সনাক্ত করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম গ্রহণে ফুসফুস, নাসারন্ধ ও সাইনাস ক্যান্সার সৃষ্টি করে। এছাড়াও খাবার বা শ্বাস-প্রশ্বাসে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, এজমা, আলসার, কাশি ও হাঁপানি রোগ সৃষ্টি করে। কিডনি বিকল, লিভার, পাকস্থলি ও ত্বকের ক্ষতিসাধনতো আছেই। শিশুস্বাস্থ্যের জন্যও ক্রোমিয়াম বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, ডিএনএ’র ক্ষতিসাধন, জিনে ত্রুটি ও গর্ভপাতের জন্য দায়ী মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম-৬।

আরও পড়ুন: চট্টগ্রাম কাস্টমসে অভিনব কায়দায় পণ্য খালাস

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক আবুল হোসেনের এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন ট্যানারিতে ১০০ টন বর্জ্য উত্পাদিত হয় যা রিসাইক্লিং করে মুরগি ও মাছের খাবার তৈরি করা হয়। এই খাবার খাওয়ানোর কারণে মুরগির বিভিন্ন অঙ্গে প্রতি কেজিতে দশমিক ৩৫ থেকে ৪ দশমিক ৫২ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। পরীক্ষায় দেশের ২৫ ভাগ মুরগিতে ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম-৬ পাওয়া গেছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা প্রতি লিটার পানিতে ক্রোমিয়ামের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করেছে দশমিক শূন্য ৫ মিলিগ্রাম।

ইত্তেফাক/আরকেজি