বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মরুকরণের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

আপডেট : ১৭ জুন ২০১৯, ০১:০৭

মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামল দেশটি হয়তো একদিন হারিয়ে যেতে পারে মরুভূমির ধূসর বালির গহ্বরে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা এমনটাই আশঙ্কা করছেন।

তারা বলছেন, মরুকরণের প্রধান দুটি বিষয় হচ্ছে একটি বিস্তৃত এলাকা জুড়ে যদি সেখানকার মাটি অনুর্বর হতে থাকে এবং যদি নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যেতে থাকে এবং বৃষ্টির অভাব ঘটে। বিগত কয়েক দশক ধরে এ লক্ষণগুলো খুব বেশিভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশে।

এ পরিস্থিতিতে কৃষিজমি সংরক্ষণ, কৃষিকাজে জৈব সার ব্যবহারে কৃষকদের উত্সাহিতকরণে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, নদীর পানি প্রবাহে যথাযথ উদ্যোগ, খাল-বিল ও জলাভূমিসমূহ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন তারা।

এ পরিস্থিতিতে আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘চলো সবাই মিলে বিশ্ব গড়ি’। বিশ্বের অনেক দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে। মানুষের জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় যোগ রয়েছে। প্রকৃতিকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করলে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। বর্তমানে অধিক রাসায়নিক সার ব্যবহার, মাটির গুণাগুণ নষ্ট করছে। তাই মাটির গুণাগুণ রক্ষা, স্বাস্থ্যসম্মত কৃষিকাজকে উত্সাহিত করতে ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন টু কমব্যাট ডেজার্টিফিকেশন (ইউএনসিসিডি) ১৯৯৫ সাল থেকে ১৭ জুন দিবসটি পালন করে আসছে। মানুষকে সচেতন করে তোলাই এ দিবস পালনের লক্ষ্য।

অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে দেশের কৃষিজমির ঊর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। সাধারণ হিসাবে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ যদি পাঁচ ভাগ থাকে তাহলে তা ঊর্বর মাটি। দেশের কৃষিজমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বর্তমানে ১ শতাংশ। রাসায়নিক সার ব্যবহার ও শাক-সবজির বদলে ধান চাষ বেশি হওয়ায় মাটি গুণাগুণ হারিয়ে অনুর্বর হয়ে পড়ছে। 

সেইসঙ্গে বর্ষা বা শীত মৌসুমে ধঞ্চে, কলাই প্রভৃতি চাষ করলে কৃষিজমির ঊর্বরতা বাড়তো। কিন্তু এখন দীর্ঘদিনের সেই প্রথাগত চাষ বন্ধ। জমির অনুর্বরতা ঠেকাতে জৈব চাষের প্রতি কৃষকদের উত্সাহিত করা উচিত। কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় সবাই ঝুঁকছে রাসায়নিক সারের দিকে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন দেশের কৃষিজমি পুরোপুরি অনুর্বর হয়ে পড়বে। যা মরুকরণ ঝুঁকির একটি প্রধান দিক।

অপর ঝুঁকিটি হচ্ছে বৃষ্টিপাতের পানি ধরে রাখে যে জলাধার তা বিপন্ন। বাংলাদেশে বৃষ্টির অভাব না ঘটলেও যে চারমাস বৃষ্টি হয় সে পানি নদীসহ খাল-বিল ও দেশের বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে আটকে থাকে। যা পরবর্তী দিনগুলোতে কৃষি ও পানির অভাব দূর করে। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমিতে যথেচ্ছভাবে কৃষিকাজ করে এসব জলাভূমি শুকিয়ে যাচ্ছে। এই জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়ায় নদীগুলো বিগত কয়েক দশক ধরে বেশিরভাগ স্থানে পুরোপুরি শুকিয়ে যায়।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এরমধ্যে মৃত ও মৃতপ্রায় নদীর সংখ্যা ১১৭টি। এদিকে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সাধারণ হিসাবে গত ৪০ বছরে শুধুমাত্র তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা— এই তিনটি নদীতেই এ পর্যন্ত বিলীন হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি। আর তার বিপরীতে নতুন ভূমি জেগেছে মাত্র ৩০ হাজার হেক্টর। প্রতিবছর কোনো না কোনো নদীর শাখা ধীরে ধীরে পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো নদী দখল হয়ে যাচ্ছে ভূমিদস্যুদের হাতে। পরিকল্পনার অভাবেই নদীমাতৃক বাংলাদেশ থেকে এভাবে নদী হারিয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ওয়ারপো’র প্রাক্তন মহাপরিচালক ও জল-পরিবেশ ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক দৈনিক ইত্তেফাককে বলেন, ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তাসহ ভারত-বাংলাদেশের আন্তঃনদীসমূহের পানি প্রবাহ দেশের নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ। তবে সেটা দুদেশের আলোচনার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হবে। কিন্তু জলাভূমি সংরক্ষণ আমাদের নিজেদের হাতে। কিন্তু সেসব সংরক্ষণে রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি এবং পরিকল্পনা না থাকায় দেশের জলাভূমিগুলো থেকে কষিকাজে অধিকহারে জল নিষ্কাশন করে জলাভূমিগুলো শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। ফলে জলাভূমিগুলো কৃষিজমিতে পরিণত হচ্ছে। যার ফলে গ্রীষ্মকালে নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। কারণ গ্রীষ্মকালে দেশের নদীগুলোর পানি প্রবাহের প্রধান উত্স ছিল এই জলাভূমির পানি। সেটা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।

মানুষের অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড এবং রাষ্ট্রের উদাসীনতার কারণেই এসব প্রতিটি পদক্ষেপে বাংলাদেশ মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের এখানেও ধীরে ধীরে কৃষিজমিসহ সকল ভূমির ওপরের স্তরে বালির পরিমাণ বাড়ছে। নদীর বালি তুলে বাড়ি নির্মাণ, জলাভূমি শুকিয়ে শস্য আবাদ হচ্ছে। এতে প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া বন্যা বাংলাদেশের জন্য একটি আশীর্বাদও। এটা দেশের বিস্তীর্ণ কৃষিজমিতে পলির স্তর ছড়িয়ে যায়। কিন্তু অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করে আমরা জমির সেই পুনরুজ্জীবনের পথও রুদ্ধ করছি।

আরও পড়ুন: সেমির স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার লড়াই আজ

এ প্রসঙ্গে গবেষক ম. এনামুল হক সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, হাউজিং ব্যবসায়ীদের হাত থেকে জলাভূমি রক্ষা, জলাভূমি থেকে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন ও চাষাবাদ বন্ধ, নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে অপরিকল্পিত বাঁধ নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা এবং বাংলাদেশের উপযোগী কৃষিকাজ ও সার ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ।

ইত্তেফাক/নূহু