শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ব্রিটেনের নির্বাচনে কারা আসছে ক্ষমতায়

আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০১৯, ২১:৫১

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

‘গণতন্ত্রের দোলনা’ বলে পরিচিত ব্রিটেনের নির্বাচনব্যবস্থা পৃথিবীর অন্যত্র মডেল বলে গৃহীত হয়ে আসছে। সেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এমনকি উচ্চারিত শব্দাবলি সভ্যতার স্মারক নামে চিহ্নিত। হাজার বছর ধরে আবর্তিত-বিবর্তিত গণতন্ত্র পরিপক্বতার দাবি নিশ্চয় করতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীব্যাপী বিরাজিত অস্থিরতার রেশ ব্রিটেনকেও যে প্রভাবিত করেছে, অনুষ্ঠিতব্য ব্রিটিশ সংসদীয় নির্বাচন তার কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রদান করছে। ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে ব্রিটেনে যে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে তারই সমাপনী প্রক্রিয়া হিসেবে বর্তমান নির্বাচনকে দেখা হচ্ছে। ২০১৬ সাল থেকে ব্রেক্সিট নিয়ে যে বিতর্কের সূচনা তা পরপর তিনটি সরকারের পতনের কারণ হয়েছে। ডেভিড ক্যামেরুন নীতিগতভাবে ব্রেক্সিটের পক্ষে ছিলেন না। তাই তিনি পদত্যাগ করলেন। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি পার্লামেন্টে পাশ করাতে বারবার ব্যর্থ হন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পার্লামেন্টের অনুমোদন ব্যতিরেকেই তিনি ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদনের চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি এই নির্বাচনের ঘোষণা দেন। আগামীকাল ১২ ডিসেম্বর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্য খ্যাত ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি এবং বিরোধী লেবার পার্টির মধ্যে নির্বাচনী বিতর্ক বেশ জমে উঠেছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়, যা সবাইকে অবাক করছে তা হচ্ছে, বৈশ্বিক বিদ্বেষ। ব্রিটেন যেহেতু আধুনিক উদার গণতন্ত্রের নিয়ামক সেখানে উগ্র ধর্মীয়, গোষ্ঠীগত, চরম মত ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি অসহিষ্ণুতা রয়েছে। আর এবারই প্রথমবারের মতো বিভিন্ন ধারার গোষ্ঠী ও দেশজ স্বার্থের পক্ষে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো সংগঠিতভাবে তাদের জোরদার প্রচারণায় নেমে পড়েছে।

এই প্রচারণার বড়ো উসকানিদাতা ব্রিটেনের ট্রাম্প বলে পরিচিত বরিস জনসন। তিনি কিছুটা লোকরঞ্জনবাদীও বটে। তিনি তার শক্ত ও উচ্চভিলাষী কথাবার্তা দ্বারা রক্ষণশীল ব্রিটিশদের তুষ্ট করার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন সময়ে তার কাছে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে ক্ষমা চাওয়ার দাবিও ওঠে। টিভি বিতর্কেও বিষয়টি উত্থাপিত হয়। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ ও সমকামীদের ক্ষেত্রেও আপত্তিকর বিশেষণ ব্যবহার করেছেন। ডানপন্থি সংবাদপত্র টেলিগ্রাফ এবং স্পেকটেটর জার্নালে তার এসব মন্তব্য ছাপা হয়েছে। তার দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে একই ধরনের বক্তব্য প্রচার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বর্ণবাদী ও বিদ্বেষ প্রচার গোষ্ঠীগুলোর অবস্থানকে সমর্থন করার অভিযোগ রয়েছে। বিদ্বেষের বিষয়টিকে ভিন্নভাবে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে দলটির মধ্যে একধরনের অনীহা সব সময় লক্ষ করা গেছে। যারা কষ্ট পেয়েছেন তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইসলামবিদ্বেষের প্রশ্নটি কনজারভেটিভ পার্টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কারণ ৩০টির মতো আসনে ভোটের ফল মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভোটের ওপর নির্ভরশীল। পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঐসব আসনে মুসলিম সম্প্রদায়ের সবাইকে ভোট দেওয়ার জন্য ধর্মীয় নেতারা উত্সাহিত করছেন। তারা সরাসরি কোনো দলের পক্ষে বা বিরুদ্ধে না বললেও ধারণা করা হচ্ছে পরোক্ষভাবে তারা লেবার পার্টির প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন।

অন্যদিকে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার অনিবার্য অনুষঙ্গ লেবার পার্টির অবস্থান কনজারভেটিভ পার্টির বিপরীত। পার্টিপ্রধান জেরেমি করবিন একজন উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল বামধারার ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত। এবারের নির্বাচনে জেরেমি করবিনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বিদ্বেষপ্রসূত প্রচারণা শুরু করেছে ইহুদি সম্প্রদায়। এদের ধর্মগুরু বা রাবাইদের প্রধান এপরাহিম মিরভিজ ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় জেরেমি করবিনের বিরুদ্ধে এক নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তিনি করবিনকে ‘প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য অযোগ্য’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তবে গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন এই ইহুদি ধর্মগুরু। লেবার পার্টির যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে ইহুদি বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে না পারার জন্য করবিনকে দায়ী করা হয়। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মন্তব্য করছেন যে, গত নির্বাচনের প্রভাব এখন অনুভূত হওয়ার কথা নয়। উল্লেখ্য যে, ঐতিহাসিকভাবে লেবার পার্টি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রধান আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত। অপরদিকে কনজারভেটিভ পার্টি ইহুদি তোষণের জন্য অভিযুক্ত। জেরেমি করবিন দলীয় প্রধান হওয়ার পর ইহুদিদের অভিযোগ বাড়তে থাকে। তবে জেরেমি করবিন ব্রিটেনের রাজনীতিতে সবচেয়ে ধর্মবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত। তিনি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-নির্যাতন, সামরিকায়ন ও আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতির বিরোধী। তিনি বরাবরই ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করে আসছেন। বিপরীতে ইহুদি লবি তাকে হামাস ও হিজবুল্লার বন্ধু হিসেবে গণ্য করে থাকে। উত্তর আয়ারল্যান্ডে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে তার অবস্থান ব্রিটিশ সরকার ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ছিল। এ কারণে তাকে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বন্ধু বলেও সমালোচনা করা হয়। সর্বোপরি বামপন্থি আদর্শ এবং বৃহত্ পুঁজিবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেও ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা তাকে তাদের জন্য রাজনৈতিক হুমকি হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এবারের নির্বাচনী ঘোষণা বা লেবার পার্টির মেনুফেস্টোতে করবিনের উদার মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। ঘোষিত মেনুফেস্টোতে ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতি সম্প্রীতির কথা বলা হয়। তবুও পরে গণমাধ্যমে করবিনের প্রতি প্রশ্ন রাখা হয় যে, তিনি ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমা চাইবেন কি না। তিনি না-সূচক উত্তর দেন। তিনি বারবার সব ধরনের বর্ণবাদ ও ধর্মবিদ্বেষের বিরুদ্ধে কথা বললেও তা বিরোধীদের সন্তুষ্ট করেনি। উল্লেখ্য যে, লেবার পার্টির পাঁচ জন এমপি গত কয়েক মাস আগে করবিনের বিরুদ্ধে ইহুদি বিদ্বেষের অভিযোগ এনে পদত্যাগ করে। জেরেমি করবিনের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশে এবারে হিন্দু সম্প্রদায়ও এগিয়ে এসেছে। বিবিসির অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছে, হিন্দু কাউন্সিল লেবার পার্টির বিরুদ্ধে কনজারভেটিভ দলের প্রার্থীদের নির্বাচিত করার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে। গার্ডিয়ান জানাচ্ছে যে, ইহুদি সম্প্রদায় কনজারভেটিভ পার্টির প্রীতি ও পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে।

যা-ই হোক, ব্রিটেনের সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য উভয় দলই বড়ো বড়ো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। বরিস জনসন ব্রিটিশ আভিজাত্য তথা রক্ষণশীলতাকে সম্বল করে নির্বাচনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ব্রেক্সিটের পক্ষে ব্রিটিশ জনগণকে সম্মত করানোর জন্যই নির্বাচনটি লড়ছেন। তার অবস্থান ট্রাম্পের মতোই অভিবাসনবিরোধী। তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, সম্মানজনক শর্তে তিনি ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনবেন। অন্যদিকে জনকল্যাণের ঘোষণা দিয়ে এগিয়ে যেতে চান জেরেমি করবিন। নির্বাচনে বিজয়ী হলে গ্যাস, বিদ্যুত্, পরিবহন ও টেলিযোগাযোগ কোম্পানিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ফিরিয়ে জনগণের দৈনন্দিন খরচ কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ইশতেহার ঘোষণা করে মার্কসবাদী হিসেবে পরিচিত করবিন বলেন, সম্পদের ওপর ধনী ও বৃহত্ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়ে তা সাধারণ জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের চরিত্র আমূল বদলে দিতে চান তিনি। ‘প্রকৃত পরিবর্তনের সময় এটাই’—এই স্লোগান নিয়ে তিনি কাজ করছেন। নির্বাচনের মাধ্যমে আলোচিত ইস্যু ব্রেক্সিটের বিষয়ে পুনরায় গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন করবিন। লেবার পার্টি আশা করছে, জনবান্ধব তাদের ইশতেহার ২০২০ সালের পর তাদের আবার ক্ষমতায় ফেরাতে সক্ষম হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জরিপ বর্তমান নির্বাচনে লেবার পার্টির পরাজয়ের ইঙ্গিত করছে। নভেম্বরের শেষ দিকে গৃহীত ‘ইউ গভ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় কনজারভেটিভ দলের সহজ বিজয়ের ইঙ্গিত দেয়। এদের সমীক্ষায় বলা হয় ক্ষমতাসীন প্রধান বিরোধী দল থেকে ৪৪টি আসন ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হবে। তারা আশা করছেন, কনজারভেটিভ পার্টি স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গেই সরকার গঠন করতে পারবে। তবে জেরেমি করবিন পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে পরবর্তী নির্বাচনী রণনীতি নির্ধারণ করছেন বলে সংবাদ সংস্থার খবরে জানা গেছে। সতর্ক পর্যবেক্ষক মহল অবশ্য আবারও ঝুলন্ত পার্লামেন্টের আশঙ্কা করছেন।

নির্বাচনী ফলাফল যা-ই হোক না কেন, বর্তমান নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে যে বিবাদ-বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়েছে তা অস্বাভাবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে, ব্রিটেনের মতো অতি উন্নত গণতন্ত্রে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবাষ্পের সূচনা হয়েছে তা ভবিষ্যত্ ব্রিটেনের জন্য উদ্বেগজনক। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মন্তব্য করেছেন যে, তার দেশ এক অরাজক অবস্থা অতিক্রম করছে। তিনি বলেন, তার নিজের দল লেবার পার্টি অথবা কনজারভেটিভ পার্টি কেউই জনগণের আস্থা আশা করতে পারছে না। সংবাদ সংস্থা রয়টারকে প্রদত্ত সাক্ষাত্কারে তিনি মন্তব্য করেন যে, ব্রিটেন স্বকীয় রাজনীতির একক উদাহরণ। আমরা এর ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। তিনি তথাকথিত লোকরঞ্জনবাদেরও সমালোচনা করেন। তিনি বর্তমান রাজনীতিকে অকার্যকর বলে বর্ণনা করেন। বর্তমান নির্বাচনকে তার জীবনে দেখা সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বলে মন্তব্য করেন। তিনি ব্রিটিশ জাতির চিন্তার পুনর্গঠনকে আশু কর্তব্য বলে মনে করেন :অন্যথায় লোকরঞ্জনবাদের পরীক্ষানিরীক্ষায় এই জাতির সর্বনাশ সাধিত হতে পারে।

n লেখক :অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়