রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মনিরুল ইসলামের (৩০) মৃত্যু নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্যের জাল। এটি আত্মহত্যা না পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, এই নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। মঙ্গলবার (৫ ফেব্রুয়ারি) টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বংশাই রোডের আসিফ ক্লিনিক সংলগ্ন মনিরুল ইসলামের শ্বশুর মো. কয়েত আলী (৫৬) বাসায় সকাল সাড়ে নয়টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। তবে বৃহস্পতিবার (৭ ফেব্রুয়ারি) মনিরুলের বড় ভাই ইব্রাহিম খলিল এবং তার স্ত্রী আইভির সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বললে উভয়ই পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দেন।
মনিরুলের পরিবারের দাবি, পরিকল্পিত ভাবে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে তার স্ত্রী আইভি আক্তার ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন। ঘটনার তিন দিন পরও পুলিশ হত্যার রহস্য উৎঘাটন করতে পারেনি। জানা গেছে, মনিরুলের পিতার নামে মো. আনোয়ার গাজী। গ্রামের বাড়ি যশোর জেরার মনিরামপুর উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামে। অপর দিকে মনিরুলের স্ত্রীর নাম আইভি আক্তার, পিতার নাম মো. কয়েত আলী। তার গ্রামের বাড়ি ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার বাংলা চৌহাটে। ২০০৭ সালে মনিরুল ও আইভি আক্তার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। দীর্ঘদিন একই বিভাগে পড়াশোনার এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরিবারের কাছে প্রেমের সম্পর্ক গোপন রেখে ২০০৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারা বিয়ে করেন। মনিরুলের পরিবার এক পর্যায়ে বিয়ে মেনে নিলেও আইভির পরিবার প্রথমে তা মেনে নেয়নি। ২০১২ সালে তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকুরীর সন্ধানে ছোটে বেড়াতে থাকেন। পরে আত্মীয় স্বজনদের অনবরোধে অবশেষে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি উভয়ের পরিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে মেনে নেন। তাদের সংসারে ৫ বছর বয়সী মুসা ইসলাম নামে এক পুত্র ও ৫ মাস বয়সী আরশি নামে এক কন্যা রয়েছে।
৩২ তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে আইভির চাকরি হয়। তিনি যোগদান করেন টাঙ্গাইলের সরকারী সাদত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে। মনিরুলও কয়েকবার বিসিএস পরীক্ষা দিলেও সফল হতে পারেননি। তার ইচ্ছে ছিল স্ত্রীর চেয়ে আরও বড় কিছু হওয়ার। একের পর এক চেষ্টা করেছেন ভাল একটি চাকরির জন্য। তারপরও তিনি হাল ছাড়েনি বলে পরিবারের লোকজন জানায়। এদিকে স্ত্রী শিক্ষকতা করলেও মনিরুল ভাল মানের কোন চাকরি না পাওয়ায় স্ত্রী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে নানা ভাবে হেয় করে আসছিল বলে তার পরিবারের লোকজন অভিযোগ করেন।
মনিরুলের বড় ভাই ইব্রাহিম খলিল অভিযোগ করেন, স্ত্রী আইভি, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং আইভির ভাই সাহেদ ও হাসান তাকে মানসিক ভাবে চাপ ও নির্যাতন করে আসছিল। ঘটনার দিন সকালে মনিরুল তার মাকে ফোনে বলেছিলেন, 'মা তুমি অপেক্ষা করো, আমি মুসাকে নিয়ে বাড়ি আসছি'। এরপর আর কোন কথা হয়নি। সকালে স্ত্রী, শ্বশুর ও শাশুরীসহ পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মনিরুলের কথা কাটাকাটি হয়। তারপরই বাড়ির একটি কক্ষের ভিতর পাওয়া যায় মনিরুলের লাশ।
মনিরুলের মৃত্যুর ঘটনায় আইভির পরিবার প্রথমে ফোন করে ইব্রাহিমকে জানায়, 'আপনারা তাড়াতাড়ি চলে আসেন, মনিরুল দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তবে কিভাবে মারা গেছে তারা তা জানায়নি'। পরে তারা জানতে পারেন বাসার একটি কক্ষে তার ঝুলন্ত লাশ রয়েছে। মনিরুলের মৃত্যু নিয়ে তখন তাদের সন্দেহ হয়।
ঘটনার দিন মনিরুলের স্ত্রী আইভি আক্তার জানিয়েছিলেন, 'উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন যাবৎ বেকার জীবন অতিবাহিত করছিলেন মনিরুল। এ ব্যাপারে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন'। তবে আইভির এই দাবি প্রত্যাখান করে মনিরুলের ভাই ইব্রাহিম ও তার পরিবার অভিযোগ করেন, 'মনিরুল একজন সৎ দক্ষ ও মেধাবী ছাত্র ছিল। তার কোন অভিমান ছিল না। মনিরুলকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে'। তারা এর সুষ্ঠু তদন্ত ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
মনিরুলের স্ত্রী আইভি আক্তার ও শ্বশুর মো. কয়েত আলীর বাসায় বিস্তারিত জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে বাসায় তালা ঝুলতে দেখা গেছে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে আইভি আক্তার ও তার বাবা মো. কয়েত আলী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'মনিরুল কেন ও কি ভাবে আত্মহত্যা করেছে, এ বিষয়ে আমরা সঠিকভাবে কিছু বলতে পারছি না'। তাদের ধারনা অভিমান করেই মনিরুল নিজেই ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
আরও পড়ুন: তুরাগ নদীতে ট্রলার ডুবে ২ জনের মৃত্যু
এদিকে ঘটনার দিন মনিরুলের মৃত্যুর ঘটনায় তার শ্বশুর বাড়ি থেকে জানানো হয়, মনিরুল ইসলাম দীর্ঘদিন থেকেই স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে শ্বশুর কয়েত আলীর বাসায় বসবাস করছেন। সোমবার (৪ ফেব্রুয়ারি) রাতেও স্বাভাবিক ছিলেন তিনি। প্রতিদিনের মতো নিজের শোবার ঘরেই ঘুমান। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসার নিচে যান তিনি। ফেরেন ৯টার দিকে। বাসায় ফিরলে স্ত্রী তাকে নাশতা খাওয়ার জন্য বললে পরে খাবেন বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন মনিরুল। এ সময় তার এই অস্বাভাবিক আচরণ দেখে স্ত্রী আইভি ও শাশুড়ি ঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করেন। এরপর কিছু সময় অতিবাহিত হলেও দরজা খোলা না হলে এবং ভেতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে চিৎকার করেন ত্রী আইভি ও শাশুড়ি। চিৎকার শুনে পাশের ভবনে কর্মরত শ্রমিকরা এসে স্টিলের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। ঘরে ঢুকে তারা দেখতে পান মনিরুল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার খবর পেয়ে মির্জাপুর থানা পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মির্জাপুর থানার উপ পুলিশ পরিদর্শক মো. আসাদ মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'প্রাথমিক ভাবে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে লাশ ময়না তদন্ত করে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ময়না তদন্ত রিপোর্ট পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে'।
ইত্তেফাক/জেডএইচডি