বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ৪ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

বিদেশী গার্মেন্টসও নির্ভর করছে স্কাইলার্ক নির্মিত দেশী সফটওয়্যার প্রোট্র্যাকার-এ

আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২১, ২০:০৬

উচ্চহারে মজুরির কারনে বিশ্ববাজারে চীনের একক বৃহত্ অবদান ৩৯ শতাংশ থেকে এ বছর অর্থাত্ ২০২১ সালে নেমে যাবে ২০-এ। বাংলাদেশ সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ। যুগোপযোগী অটোমেশন করলে অনায়াসে আয়ত্ব করতে পারবে চীনের হারানো ১৯ ভাগ বাজার। গার্মেন্টসে ও টেক্সটাইল সেক্টরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ৬ শতাংশ। আর এই ৬ শতাংশ অবদানের কল্যাণে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির আয়ের ৮৩ শতাংশের অবদান এই সেক্টরের। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যাবহার করে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহন করতে পারলে চীনের হারানো ১৯ শতাংশ বাজার বাংলাদেশ আয়ত্ব করতে পারলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে। অন্যথায় প্রতিযোগী দেশ ভারত ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার কাছে গার্মেন্টস খাতের এই অপার সম্ভাবনা হাত ছাড়া হয়ে যাবে।

তরুণ উদ্যোক্তা বি এম শরীফের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সমস্য অবলোকন করে দেখতে পান গার্মেন্টস সেক্টরে সব চেয়ে বড় সমস্যা প্রোডাকশন ম্যানুয়াল হওয়ার কারণে দিন শেষ কাঙ্খাতি উত্পাদন না হওয়া। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে প্রোডাকশন মনিটর করা জরুরি। শরীফ দেখতে পান দেশের বেশিরভাগ তৈরি পোশাক কারখানায় সার্বক্ষণিক উত্পাদন পর্যবেক্ষণ বা ট্রাক করা হয় না। একই সঙ্গে হাতে হাতে বা খাতায় হিসেব করার কারণে ভূলভ্রান্তিসহ কর্মীদের দক্ষতাও আশানুরূপ হয় না। পোশাকশিল্পে এই অব্যবস্থাপনা অবলোকন করার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের স্নাতক বি এম শরীফ ভেবেছেন কী করে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। এই চিন্তার ফসল হলো পোশাক শিল্পের জন্য Skylark Soft Limited (www.skylarksoft.com)  এর তৈরিকৃত দেশের প্রথম ও একমাত্র সফটওয়্যার প্রোট্র্যাকার। প্রোট্র্যাকার সফটওয়ার দিয়ে গার্মেন্টস এর ‘কাটিং’ থেকে‘ ফিনিশিং’ এর সবস্তরে সফলভাবে অটোমেশন করে। এই সফটওয়ারের মাধ্যমে কেবল ‘বান্ডেল কার্ড’ই নয় বরং সেকশন টু সেকশন চালানপত্র, ইনপুট তথ্য সবই সম্পাদন করা যায়। এছাড়া কারখানার একটি বড় মনিটর বা টেলিভিশন পর্দায় সর্বস্তরের কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে দেখানো হয়। এর ফলে পোশাক শিল্পের যে কোন সময় বুঝতে পারে কাঙ্খিত উত্পাদন হচ্ছে কি না। এক কথায় এটি একটি রিয়েল টাইম গার্মেন্টস প্রোডাকশন ট্র্যাকিং সিস্টেম। বি এম শরীফ জানান ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে দেশী গার্মেন্টস গ্রুপ  মন্ডল, জিএমএস কম্পোজিট নিটিং ইন্ড্রাস্টিজ লিমিটেড,  বিদেশী প্রতিষ্ঠান স্যাটার্ন টেক্সটাইলের মতো ৬০টি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সফলভাবে চলছে  প্রোট্র্যাকার। একটি ৩০ প্রোডাকশন লাইনের গার্মেন্টসে প্রোট্র্যাকার সিস্টেম বাস্তবায়ন করা হলে মাসে ওই ফ্যাক্টরিটি ৪০ লক্ষ টাকা সাশ্রয় হবে। এ কারণে বিদেশী মালিকানাধীন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানও প্রোট্র্যাকার ব্যবহার করছে।

“২০১২ সালে মাত্র ৪জন লোকবল দিয়ে স্কাইলার্ক সফট লিমিটেড এর যাত্রা শুরু করলেও এখন আমাদের জনবল ৭০ জন” জানান প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বি এম শরীফ। “স্কাইলার্কের প্রোট্র্যাকার বা আমাদের অন্যান্য সফটওয়ার দিয়ে দীর্ঘদিন দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে সেবা দেবার পর দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বব্যাপী আমাদের সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০২০ সালে আমরা ইউরোপ-বাংলাদেশ জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি। যার মূল উদেশ্য দেশ বিদেশের বিভিন্ন কোম্পানিগুলো আমাদের সফটওয়ার ব্যবহারে আগ্রহী করে তোলা ও আস্থা অর্জন করা। ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়ার মতো অনেক দেশ এখন গার্মেন্টস শিল্পে ভালো করছে। স্কাইলার্কের প্রোট্র্যাকার ব্যবহার করলে ফেব্রিকস, সময়, জনবল  সাশ্রয় তো হয়ই সাথে বাড়ে ইফিসিয়েন্সি আর সম্ভব হয় কাংঙ্খিত প্রডাকশন টার্গেট অর্জন করা। বি এম শরীফ কেবল উত্পাদন ট্যাক করেই থেমে থাকতে চাননি। তিনি জানালেন, ‘বিশেষ করে এ রকম শিল্পের জন্য বিদেশি ইআরপির দাম অনেক বেশি। অনেকে ইচ্ছে থাকলেও সেটি ব্যবহার করতে পারেন না। আবার আমাদের দেশের চাহিদা অনুযায়ী সেগুলো তৈরি হয় না। কাজে কাস্টোমাইজেশনেও প্রচুর সমস্যা হয়ে থাকে।’ এ চিন্তা থেকেই শরীফের প্রতিষ্ঠান স্কাইলার্ক সফট লিমিটেড তৈরি করেছে গোআরএমজি (goRMG ) নামে পোশাকশিল্পের জন্য সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার। এতে মার্চেন্ডাইজিং, কমার্শিয়াল, প্রকিউরমেন্ট, ইনভেনটরি, অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স, কাটিং, ওয়াশিং, ডায়িং, ফিনিশিং, নিটিংয়ের মতো প্রয়োজনীয় সব ফিচার ছাড়াও আইই, বাজেট, প্ল্যানিং, টাইম অ্যান্ড অ্যাকশনের মতো জটিল কার্যক্রমগুলো অনায়াসেই সমপন্ন করা যায়। এ ছাড়া স্কাইলার্কের আরেকটি সফটওয়্যার হলো নিট্র্যাকার যা দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাপড়ের হিসাব করা হয়।

শরীফ জানান গার্মেন্টস সেক্টরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যেভাবে সফটওয়ার অটোমেশন ব্যবহার করে এগিয়েছে সে প্রেক্ষিতে দেশের বিদ্যমান প্রায় ৫ হাজার ফ্যাক্টরিতে এখনো সে হারে প্রযুক্তি বিনিয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করে মালিকরা। তারা মনে করে ৫০ লক্ষ টাকা দিয়ে সফটওয়ার না কিনে মেশিনারি ক্রয় করা ভালো। এই মানসিকতা আমাদের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তবেই গার্মেন্টস সেক্টরে আমরা পৃথিবীতে নাম্বার ওয়ান হতে পারব। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে যে খাত থেকে, সে খাতের কারিগরি সমস্যা সমাধানে মেধাবীদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন এই তরুণ সফটওয়্যার নির্মাতা। তাঁর ধারণা, দেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন উদ্ভাবনের এক চমত্কার আবহ গড়ে তোলা সম্ভব। এজন্য উদ্ভাবনকে শিল্পে নিয়ে যাওয়া দরকার। দেশীয় উদ্ভাবকদের সুযোগ দিলে তারা তৈরি পোশাকশিল্পের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি উত্পাদন খরচ কমিয়ে সেটিকে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে সহায়তা করবে বলে তিনি মনে করেন। ভবিষ্যতেও এই খাতে নিজের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কৃষি খাতসহ অন্যান্য খাতে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে বি এম শরীফের।