মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩, ১৩ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

গণহত্যার সাক্ষী খুলনার জাদুঘর

আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২১, ২৩:০১

মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধু রণাঙ্গনের যুদ্ধ নয়। জাতির গৌরবময় এ অর্জনের প্রতিটি পাতায় পাতায় জড়িয়ে রয়েছে আত্মাহুতি আর নৃশংসতার করুণ কাহিনি। গণহত্যার বর্বর ইতিহাস। কোটি মানুষের আহাজারি, স্বামী হারানো নারীর ত্যাগ, সন্তানহারা মায়ের হাহাকার, সভ্রম হারানো যুবতির আর্তনাদ। নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়ার পণ। নিরস্ত্র বাঙালির অকাতরে প্রাণদানই ছিল বিজয়ের শক্তি। মুক্তিযুদ্ধে বর্বর গণহত্যা আর বাঙালির অকাতরে প্রাণদানের সঠিক ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য খুলনায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘১৯৭১ :গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। ১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনার চুকনগরে সবচেয়ে বড় ও নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। সে কারণেই গণহত্যা জাদুঘরটি খুলনায় স্থাপন করা হয়েছে।যেভাবে গড়ে ওঠে গণহত্যা জাদুঘর

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গণহত্যা ও নির্যাতন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোথাও এত কম সময়ে এত বেশি মানুষকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়নি। যতটা বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে করা হয়েছে। মাত্র ৯ মাসে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা এই ভূখণ্ডে হত্যা করেছে ৩০ লাখ নিরীহ মানুষকে। নির্যাতন করেছে অসংখ্য মানুষকে, ধর্ষণ করেছে ৫ লাখেরও বেশি নারীকে। তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে—স্বাধীনতার পর দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর অতিবাহিত হবার পরও বাংলাদেশে এখনো ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সমর্থ হয়নি। উপরন্তু বারবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চলেছে, শহিদ ও নির্যাতিতের সংখ্যা নিয়ে চলছে দেশি-বিদেশি অপপ্রচার। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীরা পুরস্কৃত হয়েছে। এর কারণ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমাদের বিজয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গণহত্যা ও নির্যাতনকে নয়। আর মানুষের উদাসীনতার সুযোগে ইতিহাস বিকৃতি বিস্তৃত হয়েছে। যে তরুণরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার হাল ধরবে তারা বিভ্রান্ত হচ্ছে।

এ অবস্থা অনুধাবন করে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক ও গণমুখী ইতিহাস চর্চার অন্যতম পথিকৃত্ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনের উদ্যোগে দেশের সবচেয়ে বড় গণহত্যার সাক্ষী খুলনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘১৯৭১ :গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। ২০১৪ সালের ১৭ মে খুলনা শহরে এই জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে জাদুঘর ট্রাস্টকে নগরীর সাউথ সেন্ট্রাল রোডে একখণ্ড জমি ও একটি বাড়ি উপহার দেন। সেটি সংস্কার করে নিজস্ব ভবনে গণহত্যা জাদুঘরের নবযাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ। খুলনায় স্থাপিত এই জাদুঘরটি বাংলাদেশের এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর। বর্তমানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের অধীনে ছয়তলা বিশিষ্ট নতুন জাদুঘর ভবন নির্মিত হচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে বর্তমানে জাদুঘরের কাজ পরিচালিত হচ্ছে নগরীর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার দ্বিতীয় ফেজের ৬ নম্বর রোডের ৪২৪ নম্বর বাড়িতে।

জাদুঘরের যত অর্জন

প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ছয় বছরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস সংরক্ষণে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে ‘১৯৭১ :গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় জাদুঘরের সঙ্গে যৌথ প্রদর্শনী, ভারতের ত্রিপুরা সরকারের সঙ্গে ‘গণহত্যা-নির্যাতন ১৯৭১’ শীর্ষক প্রদর্শনী, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ত্রিপুরা সরকার একটি জাতীয় উদ্যান তৈরি করেছে এবং সেখানে গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে একটি ভাস্কর্য উদ্যান গড়ে তোলা হয়েছে। জাদুঘরের উদ্যোগে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও ত্রিপুরা ১৯৭১’ শিরোনামে ত্রিপুরা জাদুঘরের একটি কক্ষ সজ্জিত করা হয়েছে, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘরকে নিয়ে একটি স্মারক খাম প্রকাশ করেছে, গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘরের প্রস্তাবে ও উদ্যোগে বাংলাদেশে গণহত্যার ৭১টি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। জাদুঘরের গ্রন্থাগারে আছে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত প্রায় ৭ হাজার বই। যা গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এযাবত্ কালের সর্ববৃহত্ সংগ্রহ। ইলেকট্রনিক আর্কাইভসে রয়েছে প্রায় ৬ হাজার মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত আলোকচিত্র। রয়েছে দেশ-বিদেশের শিল্পীদের গণহত্যা-নির্যাতন নিয়ে আঁকা ৩০টি তৈলচিত্র। রয়েছে শহিদদের দেহাবশেষের নিদর্শন, প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যবহূত দেশি অস্ত্রের গ্যালারি, রয়েছে জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার দুর্লভ স্মারক, ছবি ও শহিদদের স্মৃতিচিহ্ন। প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা-নির্যাতনবিষয়ক ১২৫টি বই। এছাড়া জাদুঘরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বই ও স্যুভেনির বিক্রির জন্য একটি বিক্রয় কেন্দ্র।

গণহত্যা জাদুঘর ও আর্কাইভের কর্মসূচি

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস সংরক্ষণে গণহত্যা জাদুঘর ও আর্কাইভের ৯টি কর্মসূচি রয়েছে। এই ৯টি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে গণহত্যার বিস্তৃত স্থান জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য জেলাভিত্তিক ‘৭১-এর বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিতকরণ, গণহত্যা-নির্যাতন নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক অনলাইন ও অফলাইন আর্কাইভ গড়ে তোলা, শিশু-কিশোরদের নিয়ে নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ইন্টার্যাকটিভ প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতার আয়োজন, গণহত্যাস্থল ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যভিত্তিক গবেষণার ভিত্তিতে গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘণ্ট, শহিদ স্মৃতি গ্রন্থ প্রকাশ, গণহত্যা-নির্যাতন নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার এবং শহিদ স্মৃতি বক্তৃতার আয়োজন, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক সৃষ্টি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে গণহত্যা-নির্যাতনের নানাবিধ তথ্য-উপাত্ত বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ওয়েবসাইট, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চর্চা ও আলোচনা বাঁচিয়ে রাখার জন্য ইয়ুথ প্ল্যাটফরম তৈরি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে অ্যাডভোকেসি করা।

উক্ত প্রকল্পগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ‘গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র’ এই ট্রাস্টের অধীনে ২০১৭ সালে স্থাপন করা হয়েছে। এই প্রকল্প দেশব্যাপী গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিবিড় গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।