শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন ও আধুনিকতার পথে অভিযাত্রা

আপডেট : ০৬ জুন ২০২১, ১৭:০০

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পর, বিধ্বস্ত অবকাঠামো ও অর্থনীতি নিয়ে, বাঙালি জাতির উন্নতির জন্য আধুনিক শিক্ষা চালু করাই ছিল তখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন, ঘরে ঘরে আধুনিক শিক্ষা পৌঁছে দিতে না পারলে এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আদর্শ মানবসম্পদ গড়ে তোলাই ছিল বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনের মূল বিষয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার এবং ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার শিক্ষার জন্যই সমান সুযোগ থাকা আবশ্যক। 

বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তব্য, নীতি ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে শিক্ষা বিষয়ে তার চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন তথ্য, দলিল ও প্রকাশনার পর্যালোচনা করে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা বিষয়ক চিন্তা ও দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ তার দুটি বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়; একটি বক্তব্য তিনি দেন ১৯৭২ সালের মার্চে চট্টগ্রামে এবং অন্য বক্তব্যটি দেন ১৯৭৩ সালের মার্চে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা-দর্শন ও বাস্তবতা - বঙ্গবন্ধু পরিষদ

১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-ই-খোদাকে প্রধান করে বঙ্গবন্ধু একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন, যার প্রধান কাজ ছিল চলমান শিক্ষাব্যবস্থাকে মূল্যায়ন করা এবং সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য যথাযথ শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের ব্যাপারে সুপারিশ করা। শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য শাসনামলের শুরু থেকেই বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাবিষয়ক চিন্তার সারমর্মটাই এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরছি।


স্বাধীনতার পর, পাকিস্তান থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে হতাশ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ৩০ মার্চ, চট্টগ্রামে শিক্ষক ও লেখকদের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় অনুশোচনা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিকশিত মানুষ সৃষ্টির পরিবর্তে এটি শুধু আমলা তৈরি করছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে না পারলে সমাজ থেকে দারিদ্র্য এবং বৈষম্য দূর করা যাবে না এবং সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। গ্রামীণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রত্যেক শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কিছু দিন করে গ্রামাঞ্চলে কাটানোর পরামর্শ দেন তিনি। বঙ্গবন্ধু আভাস দেন, দেশের টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে, যা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। তিনি বলেন, পূর্বের সকল শিক্ষা কমিশন বাঙালিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। 

বঙ্গবন্ধুর নামে পুরস্কার দেবে ইউনেস্কো
১৯৭৩ সালের ২০ মার্চ, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-এর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় শিক্ষা সম্পর্কে তার চিন্তাধারা আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। সেদিনের অনুষ্ঠানে নতুন স্নাতক সনদধারী এবং শিক্ষকদের সামনে বঙ্গবন্ধু বলেন,- ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দুইশ' বছরের ও পাকিস্তানের ২৫ বছরে গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থা শুধু কেরানি তৈরি করেছে, মানুষ তৈরি করেনি। এজন্য তিনি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেন, যার মাধ্যমে আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা যাবে এবং যার মাধ্যমে স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে সহায়তা করবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন বঙ্গবন্ধু।

তিনি বৈদেশিক নির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক করে দেন এবং এটিকে টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেন। বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন কাজ করছে এবং আশা করেন যে, এই কমিশন একটা শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ এমন একটি প্রতিবেদন জমা দেবে- যা জাতিকে সমৃদ্ধি ও মুক্তির দিকে নিয়ে যাবে।

এই দুই বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা বিষয়ক চিন্তাভাবনা ও দর্শনের মূল বিষয় উঠে আসে। দেখা যাচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধু এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যার মাধ্যমে মানুষকে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। একটি যথাযথ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের সুষম ও টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল উদ্দেশ্য।

 

বঙ্গবন্ধু তার শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা শুধু বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি তার দর্শন বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য স্বাধীনতার পরেই (১৯৭২ সালে) কুদরাত-ই-খুদা কমিশন গঠন করেছেন। এই কমিশন ১৯৭৩ সালের জুন মাসে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন এবং ১৯৭৪ সালের মে মাসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন শিরোনামে ৩০৯ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, যা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে সর্বাধিক বিস্তৃত কাজ, যেখানে শিক্ষা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও দর্শনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এর ভূমিকায় বলা হয়েছে, এই কমিশনের উদ্দেশ্য হচ্ছে 'বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটি এবং ঘাটতি দূর করা...' এবং দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে 'মানসম্পন্ন জীবনমান' অর্জনের জন্য মানব সম্পদকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন। 

এতে আরো বলা হয়েছে, এই শিক্ষা ব্যবস্থার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য মানবসম্পদের উন্নয়ন করা। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত না করে কোনো অর্থবহ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করা যায় না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে এতে। মূলত বঙ্গবন্ধুর দর্শনই প্রতিফলিত হয়েছে এই শিক্ষা কমিশনের সুপারিশমালায়।

কানাডায় আজ উদ্বোধন হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু সেন্টার’

কমিশনের প্রধান পর্যবেক্ষণগুলোর মধ্যে যেসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো হলো: শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকর্ষিত করা, শিক্ষকদের জন্য ভালো পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা, শিক্ষার সব পর্যায়ে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ, ইংরেজি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ভাষা শেখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া, শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে উচ্চ-শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তোলা, জাতীয় উন্নয়নের জন্য জাতীয় উন্নয়নের জন্য ফলিত গবেষণার উপর জোর দেওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করা, সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষাকে একটি বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা। এই কমিশন আরও সুপারিশ করেছে যে, প্রতিবছর জাতীয় আয়ের শতকরা ৫ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে তা ৭ শতাংশে বৃদ্ধির প্রস্তাবও দেওয়া হয় এই প্রতিবেদনে। 

বঙ্গবন্ধু এই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে তাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করার ফলে এগুলো আর বাস্তবায়নের সুযোগ তিনি পাননি। তবে, এই কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই, শিক্ষা বিষয়ে নিজের দর্শন বাস্তবায়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষাকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে তুলে ধরা হয়। 

১৯৭২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সকল নাগরিকদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রেসনোটে বলা হয়, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা ভাষাই হবে শিক্ষার মাধ্যম। ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ অন্য একটি প্রেসনোটের মাধ্যমে জানানো হয়, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বই পাবে এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা পাবে বাজার মূল্যের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম দামে। বঙ্গবন্ধুর সরকারের উদ্যোগে ৩৬ হাজার ১৬৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয় এবং বাড়ানো হয় শিক্ষকদের বেতন। এছাড়া নারীর উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নারীদের অবৈতনিক শিক্ষা চালু করার যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ জারি করে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের মাধ্যমে, দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। 

No description available.

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা এবং দর্শন এখন আগের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে চায়। গুণগত শিক্ষামান নিশ্চিত করা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের সুযোগ বৃদ্ধি ছাড়া কোনো দেশ উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তাই বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন বাস্তবায়ন করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আলোকিত মানুষ তৈরি ও কল্যাণমুখী সমাজ দিকে ধাবিত হওয়া আবশ্যক। 

ইত্তেফাক/ইউবি