শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

যাত্রী জিম্মি করে বাড়ানো হলো বাস-লঞ্চের ভাড়া

আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২১, ০৯:২৪

ধর্মঘটের নামে যাত্রীদের জিম্মি করে বাড়ান হলো বাস-লঞ্চের ভাড়া! ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার থেকে দেশজুড়ে বাস-ট্রাক ও শনিবার থেকে লঞ্চ ধর্মঘটের ডাক দেন গণপরিবহন মালিকরা। অবশেষে তাদের দাবির মুখে গতকাল রবিবার গণপরিবহনে নতুন করে ভাড়া সমন্বয় করল সরকার। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী বাসে ২৭% ও লঞ্চে ৩৫% ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তবে সিএনজিচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাড়ানো হয়নি।  এদিকে সরকার ভাড়া বৃদ্ধি করায় গতকাল সন্ধ্যায় বাস ও লঞ্চের ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে ডিজেলের দাম না কমালে পণ্যবাহী ট্রাক চলবে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ।

বিআরটিএ ভবনে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে গতকাল বিকালে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, দূরপাল্লার (আন্তঃজেলা) বাসে ২৭ শতাংশ আর মহানগরে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভাড়া বেড়েছে। ডিজেলচালিত সবধরনের বাসের ভাড়া আগামীকাল (আজ) সোমবার থেকে বাড়ছে। দূরপাল্লার বাসে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া হবে এক টাকা ৮০ পয়সা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাসের ভাড়া হবে প্রতি কিলোমিটারে দুই টাকা ১৫ পয়সা আর মিনিবাসে ২ টাকা ৫ পয়সা। পুনঃনির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী এখন থেকে মহানগরীতে বাসযাত্রায় যাত্রীদের গুনতে হবে সর্বনিম্ন ৮ টাকা এবং মিনিবাসের জন্য গুনতে হবে ১০ টাকা। সন্ধ্যায় বাসভাড়া বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে সরকার।

বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিআরটিএ চেয়ারম্যান ও পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। বিআরটিএ চেয়ারম্যান জানান, সারাদেশে দূরপাল্লার বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা হচ্ছে। আর মহানগরীতে বিভিন্ন রুটের বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে হচ্ছে ২ টাকা ১৫ পয়সা। মিনিবাসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে হচ্ছে ২ টাকা ৫ পয়সা। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে যেসব বাস সিএনজিচালিত সেগুলো এই নতুন ভাড়ার তালিকায় পড়বে না। সিএনজিচালিত বাস আগের ভাড়ায় চলবে।

বৈঠকে পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতা খন্দকার এনায়েতউল্যাহ, শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ ঘোষ, সোহাগ পরিবহনের মালিক ফারুক তালুকদার, কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দুই প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

লঞ্চভাড়া ৩৫% বাড়ল: ডিজেলের দাম বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে বাসের পরে বাড়ল লঞ্চভাড়াও। লঞ্চের ভাড়া ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে চলমান লঞ্চ ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কার্যালয়ে সরকারের সঙ্গে লঞ্চ মালিকদের বৈঠকে ভাড়া বাড়ানো ও ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। নতুন ভাড়া অনুযায়ী, লঞ্চভাড়া ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ১ টাকা ৭০ পয়সার পরিবর্তে ২ টাকা ৩০ পয়সা ও ১০০ কিলোমিটারের ঊর্ধ্বে ১ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জনপ্রতি সর্বনিম্ন ভাড়া ১৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেকের সভাপতিত্বে এ বৈঠক হয়। এতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাপ) সংস্থার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমদ ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বদিউজ্জামান বাদল, বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির মহাসচিব শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বাস ধর্মঘট প্রত্যাহার: ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাসভাড়া বাড়ানোর ঘোষণায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ডাকা ‘অনানুষ্ঠানিক’ ধর্মঘট তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে আজ থেকে সড়কে বাস চলাচল স্বাভাবিক হবে বলে জানিয়েছে মালিকপক্ষ। গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর সারাদেশের বাস মালিকরা বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়। আমরা তাদের সেন্টিমেন্টের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিলাম। পাশাপাশি জনদুর্ভোগ লাঘবে সবার সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তারই আলোকে আজ (গতকাল) দুপুরে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা সব মালিকদের বাস চালু করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। এখন থেকে নতুনভাবে নির্ধারিত ভাড়া নেওয়া হবে। তবে যাত্রীদের কাছ থেকে সরকারনির্ধারিত ভাড়ার বেশি কোনোভাবেই নেওয়া যাবে না।’

প্রত্যাহার হয়নি পণ্য পরিবহন ধর্মঘট: জ্বালানি তেলের দাম না কমলে পণ্যবাহী ট্রাক চলবে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান গতকাল গণমাধ্যমকে জানান, ডিজেলের দাম না কমা পর্যন্ত তারা ধর্মঘট অব্যাহত রাখবেন। বিআরটিএ সদর দফতরে ভাড়া পুনর্নির্ধারণের  যে বৈঠক হয়, সেখানে তারা অংশ নেননি। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে কোনো রকমের যোগাযোগ করা হয়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান ট্রাক প্রাইম মুভার পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মকবুল আহমেদ বলেন, আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করব না। তেলের দাম কমলেই ধর্মঘট প্রত্যাহার করব।

সর্বশেষ ভাড়া বৃদ্ধি: সরকার সর্বশেষ ২০১৫ সালে  মহানগরীতে বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা এবং মিনিবাসের জন্য ১ টাকা ৬০ পয়সা ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। বাসে ৭ টাকা এবং মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ নির্ধারণ করা হয়। সিদ্ধান্তটি কার্যকর হয় ওই বছরের ১ অক্টোবর। এরআগে দূরপাল্লার বাসের ভাড়া ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ১ টাকা ৩৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৪৫ পয়সা করা হয়। ডিজেলের দাম কমায় ২০১৬ সালের ৩ মে দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটের ডিজেলচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ৩ পয়সা কমানো হয়। ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ১ টাকা ৪২ পয়সা। তবে সে নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে কার্যত বাস্তবায়িত হয়নি।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে গত ৩ নভেম্বর রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। নতুন দাম ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়, যা বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। এর পরদিনই পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট শুরু করেন বাস-ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহনের মালিকরা। তাদের দাবি ডিজেলের দাম না কমানো হলে গণপরিবহনসহ অন্যান্য পরিবহনের ভাড়া সমন্বয় করতে হবে।

এদিকে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সারাদেশে ব্যাপক দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, বাসের ভাড়া নির্ধারণের দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। পরিবহন মালিকরা ভাড়া বাড়াতে ধর্মঘট দিয়ে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করলেও সরকার তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ভাড়া বাড়াতে চাপ তৈরির কৌশল হিসেবেই পরিবহন সিন্ডিকেট ধর্মঘট করেছে।

ভাড়া বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে গত বৃহস্পতিবার বিআরটিএর চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো পরিবহন মালিক সমিতির প্রস্তাবে বলা হয়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরসহ সারাদেশের দূরপাল্লার রুটে গত ৮ বছর কোনো ভাড়া বাড়ানো হয়নি। কিন্তু এ সময়ে গাড়ির চেসিস, টায়ার, টিউব, খুচরা যন্ত্রাংশের দাম এবং সব ধরনের কর ও ফি বেড়েছে। এ কারণে গাড়ির পরিচালন ব্যয় ‘কয়েকগুণ’ বেড়ে গেছে।

ইত্তেফাক/এমআর