বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নৈতিকতার অবক্ষয়

বাবা-মায়ের নিষ্ঠুরতার শিকার শিশুরা

আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২১, ১১:০২

সমাজে নির্মমতা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এই নির্মমতার সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে শিশু হত্যা ও নির্যাতন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। নির্দয়ভাবে একের পর এক শিশু হত্যার ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, দেশে সামাজিক ও নৈতিকতার অবক্ষয় বাড়ছে। ধীরে ধীরে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে নির্মমতা ও সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। মাদক-হতাশা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ। বাবা মায়ের কাছেই সন্তানদের সবচেয়ে বেশি নিরাপদ থাকার কথা। অথচ নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সেই বাবা মায়ের নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে শিশুরা। বড়দের স্বার্থ কিংবা লালসার শিকার হয়ে অকালেই প্রাণ ঝরছে কোমলমতি শিশুদের। ঘরে কিংবা বাইরে, পরিবার কিংবা সমাজ- কোথাও নিরাপদ নয় শিশুরা। গড়ে মাসে ৩৪ শিশুর বেশি খুন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশু হত্যা প্রতিরোধে রাষ্ট্রের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে সমাজের সচেতন সব নাগরিককে। ঘরেই শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অবক্ষয়ের কারণ চিহ্নিত করে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। তবেই নিশ্চিত হবে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ।

কুমিল্লার দেবিদ্বারে নিখোঁজের সাতদিন পর ৫ বছরের শিশু ফাহিমার ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বাবা আমির হোসেনসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। ফাহিমা দেবিদ্বার পৌর এলাকার চাপানগর (চম্পকনগর) গ্রামের ট্রাক্টর চালক আমির হোসেন ও গৃহিনী হোছনা বেগমের একমাত্র কন্যা। হোছনা বেগম বর্তমানে ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গত ৫ নভেম্বর আমির হোসেনকে পার্শ্ববতী বাড়ির মহিলা লাইলী আক্তারের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলে তার মেয়ে ফাহিমা আক্তার। ফাহিমা তার মা’কে বিষয়টি জানিয়ে দেবে বলেও জানায়। পরবর্তীতে তখন লাইলী আক্তারের প্ররোচনায় আমির হোসেনের দুই চাচাতো ভাই রেজাউল ইমন, রবিউল আউয়াল ও তাদের বন্ধু সোহেলসহ রেজাউলের ফার্নিচারের দোকানে বসে একটি পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনানুযায়ী আমির হোসেন ৭ নভেম্বর ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে ফাহিমাকে সোহেলের সিএনজিতে করে ঘুরতে যায়। সন্ধ্যা একটি নির্জন স্থানে পিতা কন্যার মাথা চেপে ধরে এবং অন্যান্য জড়িতরা তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করে। তখন লাইলি আক্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবাকে মেয়েটি বলে, আব্বু আমাকে মেরো না, আমাকে মারো কেন? মুহূর্তের মধ্যে খুনিরা তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে হত্যা করে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বিবেককে নাড়া দেয়। খুনি পিতার বিবেককে একটুও কাপেনি। পিতাসহ ৫ জন কয়েক মিনিটের মধ্যে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে। পরবর্তীতে আমির ও লাইলিসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল তথ্য তারা র‌্যাবের কাছে স্বীকার করে। 

গত ১৫ জানুয়ারি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার রামচন্দ্রপুর এলাকায় আকন্দবাড়ীর পেছনের জঙ্গলে অপহরণকারীরা মুক্তিপনের টাকা না পেয়ে শাহজাহান আকন্দের মেয়ে সানজিদা আক্তার (৭) কে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে। উক্ত সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-১৪, ময়মনসিংহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হত্যার বিষয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, পারিপার্শ্বিকতার বিচার ও নিহতের বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে নিবিড় তদন্তপূর্বক র‌্যাব-১৪ ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-১৪ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা থানার হত্যা মামলায় জড়িত সন্দেহে শাকিনুল ইসলাম (১৯) কে ময়মনসিংহকে কোতোয়ালী থানাধীন রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে গত তিন ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ৮টা ২০ মিনিটে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। গ্রেফতারকৃত আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, সুপারি কুড়ানোর নাম করে ভিকটিম সানজিদা আক্তারকে তার বাড়ির পাশের জঙ্গলে নিয়ে সে এবং ইয়াছিন মিলে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। 

গত ৬ এপ্রিল খুলনায় তানিশা আক্তার নামে পাঁচ বছর বয়সী একটি ঘুমন্ত শিশুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই দিন রাত ১০টার দিকে তেরখাদা উপজেলার আড়কান্দী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পুলিশ শিশুটির সৎ মা মুক্তা খাতুনকে আটক করে। নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার নজরপুর গ্রামের নানার বাড়িতে বেড়াতে এসে নিখোঁজ হওয়ার চারদিন পর এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শিশুটির নাম মিজানুর রহমান ওরফে আশরাফুল (৬)। স্থানীয় ব্যক্তিদের তথ্যের ভিত্তিতে সেনবাগ থানার পুলিশ মাটিতে অর্ধেক পুঁতে রাখা অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করে। পরে লাশটি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার সকাল আনুমানিক ৯টার দিকে সেনবাগ উপজেলার কাদরা ইউনিয়নের নজরপুর গ্রামের নানার বাড়ি (জিতু সওদাগরের বাড়ি) থেকে নিখোঁজ হয় শিশু মিজানুর রহমান ওরফে আশরাফুল। গত ১৭ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল সদর ইউনিয়নের  নোয়াহাটি গ্রাম থেকে আট বছর বয়সী এক শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। লাশ উদ্ধারের পর পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করছেন, শিশুটির কানে থাকা দুই আনার স্বর্ণের দুল নিতেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। গত ২২ মার্চ গাজীপুর সদরের বানিয়ারচালা এলাকায় একটি বাসার  সেপটিক ট্যাংক থেকে তিন বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। জয়দেবপুর থানার পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। শিশুটির নাম শান্ত। সে ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানার উত্তর নয়নপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. সাদেক মিয়ার ছেলে। 

গত ৩১ জানুয়ারি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানার পুলিশ টয়লেট থেকে নূর-হাওয়া নামে চার মাস বয়সের একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করে। সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার ধুমাইটারী তেঁতুলতলা এলাকার নুরুল ইসলামের টয়লেট থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে শিশুটির মা তানজি বেগমকে (৩৮) আটক করা হয়। পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ সন্ধ্যা ৬টার দিকে ধুমাইটারী তেঁতুলতলা এলাকার নুরুল ইসলামের পারিবারিক টয়লেট থেকে শিশু নূর-হাওয়ার লাশ উদ্ধার করে। রাইদা পরিবহনের চলন্ত বাস থেকে শিশু মরিয়ম আক্তারকে (১০) ফেলে হত্যার ঘটনায় চালক রাজু মিয়া ও তার সহযোগী ইমরান হোসেনকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ৯ নভেম্বর সকালে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। শিশু হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করায় র‌্যাবের কর্মকাণ্ডকে প্রশংসা করেন অভিভাবকরা। 

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক, বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, বাবা -মায়ের কাছেও সন্তানরা নিরাপদে থাকছেন না। এছাড়া জায়গা নিয়ে বিরোধ, কিছু হলেই ঝগড়া, প্রতিবেশিকে ফাঁসাতে শিশুকে হত্যাও করা হচ্ছে। আসলে মানুষের মধ্যে হিংস্রতা বাড়ছে। বাবা-মায়ের কাছে শিশুরা নিরাপদে থাকবে এটাই স্বাভাবিক, অথচ সেই বাবা-মা সন্তানদের হত্যা করছে। এর চেয়ে নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে? শিশু হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা কোন না কোনভাবে মাদকে সম্পৃক্ত। এই মাদক আমাদের বিবেক ধ্বংস করে দিচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। এটা এখনই রোধ করতে হবে। ‘আমার শিশু আমার কাছে নিরাপদ’ এই স্লোগানে প্রতিটি পরিবার থেকে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ঘর থেকেই মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়, আগেও ছিলো। তবে এর হার বাড়ছে। মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, এর ফলে আত্মঅহমিকা, ক্ষোভ, রাগ ইত্যাদির কারণে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। এর পাশাপাশি এর জন্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশও দায়ী। তিনি বলেন, চারপাশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া নির্যাতন বন্ধ সম্ভব নয়। আর শুধুমাত্র সরকারের পক্ষে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব নয়, আমাদের চারপাশের মানুষকেও এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।

সামাজিক অপরাধবিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, এটি আমাদের সমাজের একটি প্রাচীন রূপ। একেকটি শিশু একেক কারণে নির্যাতনের শিকার হয়। অতীতকাল থেকেই আমাদের সাধারণ মানুষের যে গ্রামীণ বৈশিষ্ট্য, মানসিক পরিস্থিতি, গোষ্ঠীগত দ্বন্ধ ইত্যাদির কারণে শিশুরা বলির পাঠা হয়ে উঠে। এর বাইরেও শিশু আইনের নিষ্পত্তি আমাদের সমাজে খুব ধীরে সমাধান হয়। এগুলো দ্রুত সময়ে নিষ্পন্ন করা প্রয়োজন। আমাদের সকলের উচিত একটি শিশুবান্ধব সমাজ তৈরি করা, শিশুদের মতামত, তাদের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। একই সঙ্গে আমাদের সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কাঠামো যুগোপযোগী করে শিশুবান্ধব করে তৈরি করতে হবে। 

ইত্তেফাক/জেডএইচডি