পানি ছাড়া জীবন চলে না। প্রাকৃতিক ভারসাম্যও রক্ষা হয় না। এজন্যই বলা হয়, পানির অপর নাম জীবন। সমগ্র পৃথিবী ও মানুষের শরীরে চার ভাগের তিন ভাগ পানি। নদীমাতৃক দেশ এখন নদীবিহীন। প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশ নদীরই দান। প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা ও প্রাণীকূলকে বাঁচিয়ে রাখে নদী। নদী ছিল বাংলাদেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে সহায়তা করেছে নদী। নদীর তীরে নগর, বন্দর গড়ে উঠেছে। গোটা দেশটাই যেন নদী দিয়ে মোড়ানো। তাই প্রাণ না থাকলে যেমন প্রাণী বলা যায় না, তেমনি নদী না বাঁচলে দেশ রক্ষা হয় না।
বড় বড় নদী-উপনদী, শাখানদী, হাওড়-বাওড়, খাল-বিল-ঝিল, পুকুর ও জলাভূমির কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি বদ্বীপ। নদীতে পানি না থাকলে বৃষ্টি হয় না। ভূ-পৃষ্ঠের নিচেও পানি থাকে না। সূর্যের তাপে নদী, খাল, বিল ও জলাশয়ে থাকা পানি জলীয়বাষ্প হয়ে আকাশে উড়ে যায় এবং মেঘ-বৃষ্টি আকারে ভূ-পৃষ্ঠে পুনরায় পতিত হয়। মহান সৃষ্টিকর্তার দেওয়া এ নিয়মকে পানিচক্রও বলা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশ নদীকে সবচেয়ে বড় সম্পদ হিসেবে গণ্য করলেও আমাদের দেশে নদী হচ্ছে ময়লা আর্বজনা ও মলমূত্রের স্হান। কারণ নদীর মালিকানা সরকারের। তাই নদীর কোনো মূল্য নেই!
দেশে আদম শুমারি হলেও নদী শুমারি হয় না। মহামান্য হাইকোর্টকে নদীর সংখ্যা গণনায় নিদের্শ দিতে হয়। এদেশে জমির একহাত আইল নিয়ে যুগ যুগ ধরে মামলা করে ১০ গুণ মূল্য হারালেও ক্ষতি হয় না। অথচ দেশের মূল্যবান সম্পদ নদী রক্ষার্থে কোনো প্রতিবাদ হয় না। আমলাতন্ত্রের সহায়তায় দখলবাজরা গ্রাস করছে পানির উত্স। একশ্রেণির মানুষের হীনম্মন্যতার কারণে নদ-নদী দখল ও ভরাট সর্বনাশের আক্ষেপ এখন দেশ জুড়ে। নদীপথের যোগাযোগ এখন প্রায় বন্ধ। বালু উত্তোলন ও নদীর তীর কেটে ইটভাটা তৈরির কারণে নদী ভাঙন প্রবল হচ্ছে। শত শত মানুষ ভূমিহীন হয়ে ঘর-বাড়ি ছাড়া।
স্বাধীনতার আগে দেশে নদী ছিল ৭০০-র বেশি। বর্তমানে ৪০৫টি। ২৪ হাজার নদী পথের মধ্যে আছে মাত্র ৩ হাজর ৮২৪ কিলোমিটার। হারিয়েছে প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার। নদীতে মাছ ধরা, নৌকায় পারাপার এখন চিত্রশিল্পীর দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে। এদেশের আদি বসতি সবই ছিল নদীকে কেন্দ্র করে। দেশের প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বুড়িগঙ্গা, ব্রম্মপুত্র, কর্ণফুলী, তিস্তা এবং সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, কালনীর এখন মরণদশা। এসব নদী ও শাখা নদী, উপনদী এবং সংযোগকারী খাল-বিলে এখন পানি সংকট ও দখল দূষণে। নদীর বুকে বড় বড় চর ভেসে উঠেছে। দিনে দিনে দখল দূষণে নদী ও জলাশয়ের মৃতু্যর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। জবর-দখলের কারণে নদী স্বাভাবিক চেহারা হারিয়ে বিপন্ন। কিছু কিছু নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করায় পানি আলকাতরার চেহারা ধারণ করে পচা দুর্গন্ধে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। নদী বিপর্যয়ের কারণে দেশের বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে পড়েছে। ৮০ ও ৯০ দশকেও এসব নদী দিয়ে লঞ্চ, জাহাজ, স্টিমার, বড় বড় নৌকায় শিল্প কারখানার ভারি মালামাল ও যাত্রী চলাচল করতেন। সে সময় নদীতে ২৯০ প্রজাতির মাছ দেখা গেলেও এখন হাতেগোনা কয়েক প্রজাতির মাছ আছে। বিশ্বের একমাত্র জোয়ারভাটার নদী হালদাতে স্বচ্ছ পানি থাকায় রুই মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র এবং কার্প মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করে বছরে ৮০০ কোটি টাকা আয় করা হচ্ছে। হালদাকে রুই মাছের জিন ব্যাংকও বলা হয়।
নদী দিয়ে আসা পলি মাটির উর্বর জমিতে অধিক ফসল উত্পন্ন হয়। শিল্প কারখানা, কাগজ ও চামড়া শিল্প এবং বিদু্যত্ উত্পাদনে প্রচুর পানির প্রয়োজন। পানির অভাবে কৃষি অর্থনীতিতে জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। গত দুই দশক আগেও দেশে নদীর মাছের অবদান ছিল ২৮.৫ শতাংশ। বর্তমানে তা ৬ শতাংশ। এ অবস্হায় দেশের জেলে পরিবার অনাহারে-অর্ধাহারে জীবনযাপন করছে। কৃষিপ্রধান উত্তরবঙ্গ ও সিলেট অঞ্চলে মরুকরণ দেখা দিয়েছে।
খ্িরষ্টপূর্ব ৪৫০ বছরের পুরানো সভ্যতার খোঁজ মিলেছে নরসিংদীর উয়ারি-বটেশ্বর ব?হ্মপুত্রের তীরে। মহাস্হানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতি, কোটালি পাড়া, সোনারগাঁ, খলিফাতাবাদ, বার বাজার জনপদ গড়ে উঠতে ভূমিকা রেখেছে নদী। আবুল ফজলের বিখ্যাত আইন-ই আকবরি বইয়ে বলা হয়েছে, তখন ঢাকা ছিল নৌবহরের সদর ঘাঁটি। ১৯৬৮ সালে ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালি উল্লাহ মরা নদী ও নদীর তীরবর্তী মানুষকে লেখেন, ‘কাদোঁ নদী কাদোঁ, উপন্যাসটি।
আসাম থেকে উত্পন্ন হওয়া সুরমা ও কুশিয়ারা সিলেট-ছাতক-সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আজমিরীগঞ্জে গিয়ে মেঘনায় মিলিত হয়ে এবং কুশিয়ারা ও কালনী একসঙ্গে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়। এসব নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহিত হচ্ছে না। ফলে দূষণ ও পানি সংকটের কারণে সিলেটে কৃষি উত্পাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর-বালাগঞ্জ, জগন্নাথপুর-ছাতকের অবস্হা করুণ। ভাটিঅঞ্চল সুনামগঞ্জেও এখন তীব্র পানি সংকট। পানির অভাবে ইরি-বোরোর চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। সুরমা নদী থেকে বাসিয়া নদীটি উত্পত্তি হয়ে বিশ্বনাথ থানা সদরের ওপর দিয়ে গিয়ে কুশিয়ারা নদীতে মিলিত হয় এবং খাজাঞ্চী নদীটি লামাকাজী ইউনিয়নের হাজারিগাঁও গ্রামের পাশে মরা সুরমা হতে উত্পত্তি হয়ে দক্ষিণ দিকে রাজাগঞ্জ-টুকেরবাজার হয়ে মাকুন্দা নাম ধারণ করে রসূলগঞ্জে গিয়ে কুশিয়ারা নদীতে মিলিত হয়। এই অঞ্চলের শত শত গভীর নূলকূপেও পানি আসছে না। বাসিয়া ও খাজাঞ্চী নদীর সংযোগকারী চরচন্ডি উপনদীটি মুফতিরগাঁও-চৈতননগর হয়ে চাউলধনী হাওরে মিলিত হয়। এ নদীর ওপর এখন ঘর-বাড়ি নির্মিত হয়েছে। সোনালী বাংলাবাজারের কাছে মাকুন্দা থেকে উত্পত্তি হওয়া শাখা নদীটি লাকেশ্বর হয়ে বুরাইয়া বাজারে মিলিত হয়। বর্তমানে নদীটি অস্হিত হয়ে একটি মরা খালে পরিণত হয়েছে। বিশ্বনাথের চান্দিখাল, বাসিয়া-রামধানা খাল, সোনালী বাংলাবাজার-ব্রা?হ্মণঝুলিয়া খাল, আমতৈল-কোমারপাড়া খাল, চাউলধনী-বৈরাগীবাজার খাল, পাচলা খাল, পাকিছিড়ি-দোয়ারিগাঁও-কল্লা-মইনপুর খাল, ইসলামপুর-রহিমপুর খাল, নোয়াগাঁও-বন্দুয়া-পালেকচক খাল, নকীখালি-উজাইজুরি খাল, রশিদপুর-খাইয়াকাউড় খাল, নাজিরবাজার-চিন্তামইন খাল, মাটিজোড়া নদী, ভাটপাড়া-কাবিলপুর ও ভাবনী খালসহ অসংখ্য খাল, বিল, নালা জমির সঙ্গে মিছে গেছে এবং মানচিত্র থেকে বিলীন হয়েছে। পানির এসব উত্স এসএ রেকর্ড মতে সীমানা নির্ধারণ পূর্বক জবর-দখল থেকে উদ্ধার করা জরুরি। না হয়, এই অঞ্চলে পানির অভাবে মরুকরণ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিবে।
নদীর মালিকানা পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ অনেক মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে। কিন্তু নদী রক্ষায় কেউই তেমনভাবে উদ্যোগী নয়। আমলাদের মনোভাব, নদী সরকার কা মাল, দরিয়া মে ঢাল। সারাদেশে মেঘনাসহ বড় বড় নদী, ৬ হাজার ৫৩৫টি খাল এবং ১৮ হাজার ৪০৩টি পুকুর খননের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বর্তমান সরকার। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি তিন ধাপে ২১টি প্রকল্পের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হবে। যেসব নদী, খাল খনন করা হয়েছে, তার অধিকাংশ নদীর তীরের ঘাস পরিষ্কার করে অর্থ সাগর চুরি করা হয়েছে। বাসিয়া ও খাজাঞ্চী নদী খননের নামে হরিলুট করা হয়েছে। নদীসহ পানির উৎসসমূহ খনন করলে মত্স্য ও কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি পাবে। মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা মিটবে এবং সর্বাবস্হায় দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা মরুকরণের অবস্হা থেকে রক্ষা পাবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজ বিশ্লেষক