বিধাতায় এই বিশ্বটাকে সাধারণ নিরীহ মানুষের পাশাপাশি লড়াকু ও মানবতাবাদী মহামানব দিয়ে যেমন ভরেছেন, তেমনি ভরেছেন জনমানুষ বিধ্বংসী, বিশ্বশান্তি বিনষ্টকারী দানব ও দস্যু-দৈত্যে। কী বিচিত্র এই জগৎ-ভূম!
অস্ট্রিয়ার এক মহামানব, এক নারী, ৩২ বছরের তরুণী-মহান সৃষ্টিকর্তা তাকে দিয়েছেন অকল্পনীয় এক মহৎ হৃদয়, দুনিয়ার সব অসহায় মানুষকে রক্ষায় তিনি নেমেছেন এক মহান লড়াইয়ে। নাম তার মার্লেন এঙ্গেলহর্ন- জনমানুষের কল্যাণের লড়াইয়ে এক প্রকৃত দানবীর। উলটো দিকে আমরা বিশ্বে দেখতে পাই এমন যুদ্ধবাজ নেতাদের, যারা মানববিধ্বংসী পারমাণবিক বোমাসহ ভয়ংকর যুদ্ধাস্ত্র তৈরির উন্মত্ততায় মাতাল। কেউ কেউ সমাজতন্ত্রের নামে তাদের দেশকে স্বৈরতন্ত্রের চরম এক লীলাভূমি বানিয়েছেন। নিজ দেশবাসীকে শোষণ করে নিংড়ে খাচ্ছেন। নিজ দেশের অর্থসম্পদ গিলে খাচ্ছেন। রাষ্ট্র-রাষ্ট্রবাসীদের অর্থনীতি ও সমাজকে লুণ্ঠন করে বিশাল ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। ভোগ-বিলাসের লালসার সাম্রাজ্যে পরিণত করেছেন নিজ নিজ দেশকে।
জার্মান বেতারকেন্দ্র 'ডয়চে ভেলে' ও সংবাদ সংস্থা 'এএফপি' পরিবেশিত সংবাদের বরাতে ঢাকার এক বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক খবর- অস্ট্রিয়ার ৩২ বছরের তরুণী মার্লেন এঙ্গেলহর্ন পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিপুল সম্পদের একটা বড় অংশ দান করে দিচ্ছেন। তার এই দান করে দেওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ২ কোটি ৬৮ লাখ ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩১৫ কোটি টাকা। এই অর্থ ৭৭টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে ভাগ করে দিয়ে মানবকল্যাণে ব্যবহার করা হবে। সেই উপলক্ষ্যে দাতা তরুণী ৫০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির একটি 'নাগরিক পরিষদ'-কে দিয়ে এই অর্থ ভালোভাবে ব্যবহারের উপযোগী প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করেন। সে কাজেও তার অর্থ, শ্রম ও সময় ব্যয় করতে হয়েছে। সম্প্রতি এই নাগরিক পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে ৭৭টি সংগঠনের নাম ঘোষণা করেন। এসব প্রতিষ্ঠান পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, সাশ্রয়ী আবাসন ও অন্যান্য সামাজিক সমস্যা নিয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। উল্লেখ্য, মার্লেন এঙ্গেলহর্ন বিখ্যাত কেমিক্যাল কোম্পানি 'বিএএসএফ'-এর প্রতিষ্ঠাতা ফিডরিশ এঙ্গেলহর্নের বংশ সদস্য। ২০২২ সালে তার দাদি মারা যাওয়ার পর এই সম্পদের মালিকানা পান। সম্প্রতি তিনি বিশাল সম্পদের বড় অংশ এভাবে মানবকল্যাণে দান করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
কী এক বিশাল হৃদয় মার্লেন এঙ্গেলহর্নের, ভাবতেই তো ভিরমি খেতে হয়। ক'জন আছেন এরকম মার্লেন যিনি অকাতরে এমন বিশাল পরিমাণ অর্থ দান করে দিতে পারেন জনকল্যাণে! তিনি তো ইচ্ছা করলে এর একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ (১০ বা ২০ শতাংশ বা এইরকম ছোট অঙ্কের) মানবকল্যাণে দান করতে পারতেন। না, মার্লেনের দৃষ্টিভঙ্গি তেমনটা নয়, তার রয়েছে বিশাল হৃদয়, তাই তো তিনি নিজের পাওয়া সম্পদের বড় অংশ (মানে অবশ্যই তা কমপক্ষে ৫০ শতাংশের বেশি) গণমানুষের প্রতি ভালোবাসায় দান করে দিতে পেরেছেন। আমাদের সবার উচিত দানবীর মার্লেন এঙ্গেলহর্নকে অভিবাদন জানানো, আর তার আদর্শ অনুসরণ করে নিজ নিজ সামর্থ্য মতো জনমানুষের কল্যাণে দান-অনুদান করা।
একদিকে অন্যদিকে নেতার কথা অস্ট্রিয়ার তরুণী মার্লেন আর যুদ্ধবাজ বা যুদ্ধংদেহী এমন দুই জানি, যাদের নাম মুখে আনতে আমাদের লজ্জা হয়। তাদের একজন দীর্ঘকাল ক্ষমতায় রয়েছেন প্রচুর জাল-জালিয়াতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে। তিনি একটি কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক এজেন্ট। তার বিরুদ্ধে অপরিসীম দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল রাষ্ট্রীয় অর্থসম্পদ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিভিন্ন ঘাতক ও নিপীড়ক বাহিনী সৃষ্টি এবং তাদের দিয়ে বিরোধী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের গোপনে হত্যা করে চলেছেন; তাদের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি করে, নানা রকম নিপীড়ন করে সমগ্র রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয় শ্বেত-সন্ত্রাসের নজির সৃষ্টি করেছেন। সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জালিয়াতির মাধ্যমে জয়লাভ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। সবারই জানা যে, সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো নিয়মরীতি, নিরপেক্ষতা এবং সার্বিকভাবে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় ভোটদানের মাধ্যমে যথাযথ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি দৃশ্যমান ছিল না। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তার ছেলেমেয়েরা পিতার অবৈধ ক্ষমতার অপব্যবহার করে, দুর্নীতির মাধ্যমে ৭ লাখ থেকে লাখ কোটি টাকার সম্পদ-সম্পত্তির মালিক। তিনি যে বিলাসবহুল প্রাসাদ এবং গাড়ি ও বিমান ব্যবহার করেন সেসবও নজিরবিহীন রাষ্ট্রীয় অর্থসম্পদের নিদারুণ অপচয়ের নজির বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের ওয়াশরুমের একটি কমোডের (সোনার পাতে মোড়ানো) দাম প্রায় আড়াই কোটি টাকা। যেখানে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা মূল্যে তৈরি একটি কমোড হতে পারে বিশ্বমানের বা তার চেয়েও উন্নত ধরনের, সেখানে এই অপচয়ের মানে কী হতে পারে!
অন্যদিকে আরেক নেতা নিজ দেশের ৪০-৪৫ লাখ লোককে দুর্ভিক্ষাবস্থায় রেখে পারমাণবিক বোমা বানানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এবং দুই জনের কী মিল ও বন্ধুত্ব! নিজ দেশের মানুষ উপযুক্ত খাদ্যপানীয় না পেয়ে নিদারুণ অসহায় দশায় অপুষ্টিতে ভুগে সর্বস্বান্ত। অথচ তিনি পরিবার-পরিজনকে নিয়ে ভোগ-বিলাসের মহা লীলায় ব্যস্ত। তার ব্যক্তিগত প্রাসাদ, গাড়ি, বিমান, ট্রেন নজিরবিহীন ভোগ-বিলাসের নজির সৃষ্টি করেছে। তার বন্ধু তাকে একটি বিলাসবহুল গাড়ি 'আওরোস' উপহার দিয়েছেন, এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে একই মডেলের আরেকটি 'আওরোস' গাড়ি উপহার দেন তিনি।
জানা গেছে, এই অতি বিলাসী গাড়িটির মূল্য শুরুই হয়েছে বাংলাদেশি টাকায় ৫ কোটি থেকে। তার মানে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা দামের এই 'আওরোস' লিমুজিন উপহার দেওয়া হয়েছে। অথচ তার দেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত ৪০-৪৫ লাখ মানুষকে খাবার সাহায্য দেওয়ার কোনো আয়োজন নেই। দুই জন নেতার ভোগ-বিলাসিতার কথা উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করলাম মাত্র। অর্থাৎ একদিকে চরম অমানবিক মানুষের উপস্থিতি লক্ষ করছি আমরা, অন্যদিকে অস্ট্রিয়ার ৩২ বছরের তরুণী মার্লেন এঙ্গেলহর্ন, যার মানবিক দানশীলতা বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করছে। যদিও তার কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতার উচ্চাভিলাষের কথা জানা যায় না। এখন প্রশ্ন, কাকে এই বিশ্বের বেশি প্রয়োজন? কবি বলেছেন, 'মানবের তরে পৃথিবী, দানবের তরে নয়'। আমরা দানবদের আলিঙ্গন করব নাকি মানবপ্রেমীদের? আমাদের অবস্থান অবশ্যই সুস্পষ্ট করতে হবে।
লেখক: বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক