শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রফতানি কমলেও চা উৎপাদন বেড়েছে

আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০৩:৫৮

বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকটি রপ্তানি পণ্যের তালিকায় একদা চায়ের অবস্থান ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ৫০ বছরে চা-বাগানের সংখ্যা দ্বিগুণ এবং উৎপাদন তিন গুণ হওয়া সত্ত্বেও রপ্তানি সেভাবে বাড়েনি। এর কারণ দেশেই বেড়েছে চায়ের ব্যবহার। চা পানে অনভ্যস্ত বাঙালির এখন যেন চা না হলে চলেই না। তাই রপ্তানি কমে যাওয়াকে নেতিবাচক হিসেবে দেখতে রাজি নন চায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বরং তারা মনে করছেন, ১৭ কোটি মানুষের এই দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাই চা-শিল্পকে একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর উৎপাদন বাড়লে রপ্তানি তো হবেই। 

এক সময়ে চায়ের রাজধানী মনে করা হতো সিলেটকে। কিন্তু কালক্রমে সেই চা-বাগান এখন আর সিলেটেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং পাহাড় ছেড়ে চা-বাগান এখন নেমে আসছে সমতলে। বাংলাদেশের আবহাওয়া চা চাষের জন্য খুবই সহায়ক, যা এখন আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। এদেশে উৎপাদিত চা গুণগত মানেও বিশ্বমানের। নতুন নতুন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসায় চায়ের সম্ভাবনাও ক্রমেই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতরও হচ্ছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন ১৬৭টি বাগানে চা উৎপাদিত হচ্ছে। বৃহত্তর সিলেটেই ১৩৫টি চা-বাগান। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯১, হবিগঞ্জে ২৫ ও সিলেটে ১৯টি। এছাড়া চট্টগ্রামে ২২, পঞ্চগড় জেলায় সাত, রাঙ্গামাটিতে দুই এবং ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা-বাগান রয়েছে। এর বাইরে অনেকগুলো চা-বাগান এখন উৎপাদনে যাওয়ার প্রক্রিয়ায়। পাহাড় ছেড়ে সমতলেও নেমে আসছে চা-বাগান। দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলো চা-বাগানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে চা-শিল্পের বিকাশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। চা-শিল্পকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার আগে ১৯৫৭-৫৮ সময়কালে চা-বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। সে সময়ে চা-শিল্পে মাঠ ও কারখানা উন্নয়ন এবং শ্রম কল্যাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর যে কটি রপ্তানি পণ্য হতো, তার মধ্যে চা ছিল বিশেষ অবস্থানে। এদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে শুভেচ্ছা হিসেবে চা পাতা পাঠানোর নজির রয়েছে। চা উৎপাদন বাড়লেও রপ্তানি সে হারে বাড়ছে না। এর কারণ চায়ের গুণগত মান কিংবা আন্তর্জাতিক বাজার কমে যাওয়া নয়। বরং এদেশের মানুষের বড় অংশ এখন চা পান করে। এটি মানুষের আয় বৃদ্ধি এবং আধুনিকতার প্রকাশ। 

দেশের আর্থিক উন্নতি হওয়ার কারণে মানুষের জীবনযাত্রায়ও উন্নয়ন ঘটছে। ফলে বাড়ছে চায়ের চাহিদা। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশের নিজেরই ভোগ কম নয়। মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটছে। চা ক্রমেই অপরিহার্য একটি পানীয় হিসেবে রূপ নিচ্ছে। চায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গবেষণা অনুযায়ী ২০০১ সালে দেশে প্রতি জনের গড় চা পানের পরিমাণ ছিল ১১৩ কাপ। ২০ বছর পর তা উন্নীত হয়েছে ২৩০ কাপে। স্বাধীনতার পরে বার্ষিক চা উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ কেজি। এখন তা বেড়ে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি কেজিতে উন্নীত হয়েছে। গত ২০১৯ সালে চা উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি, এখন যা আরো বেশি বৈ কম নয়। ২০২৫ সালে অন্তত সাড়ে ১২ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। কারণ এর মধ্যে বিদ্যমান চা-বাগানে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদনে এসে পড়বে আরো কিছু চা-বাগান। পুরোনো চা-বাগানগুলো সম্প্রসারণের পাশাপাশি নতুন চা-বাগান গড়ে উঠছে। এখানে উচ্চফলনশীল চা-গাছ লাগানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে পাহাড়ে যে চারা লাগানো হচ্ছে সেগুলো হাইব্রিড ক্লোন চা এবং সমতলে বাইক্লোন চা। চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষ করে পঞ্চগড় জেলায় সমতলে চা-বাগান এই শিল্পে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। চা-বাগানের জন্য বেশি উর্বর ভূমির প্রয়োজন হয় না। অনুর্বর পাথুরে ভূমি চা চাষের জন্য উপযোগী। সাধারণত এ ধরনের জমিতে অন্য ফসল হয় না। 

এখন পুরোনো চা-বাগানে নতুন গাছ যেমন লাগানো হচ্ছে, তেমনিভাবে নতুন বাগানও গড়ে উঠছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের বান্দরবানেও এখন চা-বাগান গড়ে উঠছে। এক সময় যে পরিমাণ উৎপাদিত হতো, তার ৫০ ভাগই বিদেশে রপ্তানি করা যেত। কারণ, তখন এদেশের মানুষ এত বেশি চা পান করত না। কিন্তু এখন উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও রপ্তানি নেমে এসেছে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশে। দুই দশক আগেও যেখানে ১ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা রপ্তানি হত, তা এখন নেমে এসেছে ১০ ভাগের এক ভাগে।

আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের চাহিদা ব্যাপক। কারণ এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পানীয়। চায়ের বিশ্ববাজারে সেই আগের অবস্থান ফিরে পেতে হলে উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ চা উৎপাদনকারী দেশ। এর চা-শিল্প ব্রিটিশ শাসনামল থেকে চলে আসছে, যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে চা ব্যবসা শুরু করে। 

বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬৭টি বাণিজ্যিক চা এস্টেট রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কর্মক্ষম চা-বাগান। এখানকার এই শিল্প বিশ্বের ৩ শতাংশ চা উৎপাদন করে থাকে এবং ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। এখানকার উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলীয় জেলাসমূহে চা উৎপাদন হয়ে থাকে; উচ্চভূমি, উষ্ণ জলবায়ু, আর্দ্র এবং অতিবৃষ্টিপ্রবণ এলাকাসমূহ উন্নতমানের চা উৎপাদনের মোক্ষম পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়। অমিত সম্ভাবনার অনুপাতে অনেকটা অর্জিত না হলেও এই শিল্পের অর্জনও কিন্তু কম নয়। এই অঞ্চলে প্রথম চা-বাগান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৮২৮ সালে। অবিভক্ত ভারতে চট্টগ্রামের কোদালায় তখনই জমি নেওয়া হয়। বর্তমানে যেখানে চট্টগ্রাম ক্লাব ১৮৪০ সালে সেখানেই পরীক্ষামূলকভাবে রোপণ করা হয় প্রথম চা গাছ। 

প্রথম বাণিজ্যিক আবাদ শুরু হয় সিলেটে, ১৮৫৪ সালে। সে বছর সিলেট শহরের উপকণ্ঠে মালনিছড়া চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বাগানে চা উৎপাদনের মধ্য দিয়ে চা-শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে ধীরে ধীরে চা এদেশে একটি কৃষিভিত্তিক শ্রমঘণ শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, আমদানি বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে চা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। চা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ক্রমাগত নগরায়নের ফলে ও জনতার শহরমুখিতার কারণে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। এছাড়া সামাজিক উন্নয়নের ফলেও চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে। বিগত ৩ দশক ধরে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফলে চায়ের রপ্তানি হঠাৎ করেই কমে গেছে। তার পরও জাতীয় অর্থনীতিতে চা-শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম এবং সুদূরপ্রসারী। 

জিডিপিতে চা-খাতের অবদান ০ দশমিক ৮১ শতাংশ। কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ইরান, যুক্তরাজ্য, আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, কুয়েত, ওমান, সুদান, সুইজারল্যান্ডসহ অনেকগুলো দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের চা। গত ১০ বছরে পৃথিবীতে চায়ের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে। এই চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশ, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর প্রায় ৫২ ভাগ চায়ের চাহিদা পূরণ করছে।

চা-শিল্প বর্তমানে বিনিয়োগের অভাবে তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন। বিদ্যমান ব্যাংক ঋণের সুদের হার এত বেশি যে বিনিয়োগের জন্য ঋণের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা উৎপাদনকারীদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চা চাষাধীন জমির মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশ অতিবয়স্ক, অলাভজনক চা এলাকা রয়েছে যার হেক্টরপ্রতি বার্ষিক গড় উৎপাদন মাত্র ৪৮২ কেজি। এই অতিবয়স্ক চা এলাকার কারণেই হেক্টরপ্রতি জাতীয় গড় উৎপাদন বৃদ্ধি করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তাছাড়া চা-বাগানের জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ, চা-কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা এ শিল্পের উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেও চায়ের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। 

উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে না পারলে আগামীতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বাংলাদেশের চা বিদেশে রপ্তানি করা খুব কঠিন হবে। চা-খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ অপরিহার্য। চায়ের মাঠ ও কারখানা উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য নিম্ন সুদে, সহজ শর্তে পর্যাপ্ত তহবিল প্রয়োজন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা এক নীতিমালায় চা রপ্তানিতে উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের প্রণোদনার সিদ্ধান্ত এসেছে। নিজস্ব বাগানে উৎপাদিত চা রপ্তানির ক্ষেত্রে এফওবি মূল্যের ওপর ৪ শতাংশ হারে এই প্রণোদনা লাভ করবেন উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকরা। এই সুবিধা চা উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রপ্তানিকে উত্সাহিত করবে বলে মনে করছেন এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। 

ইত্তেফাক/এএইচপি