শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ওমিক্রনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ 

চিকিৎসাসেবার সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:৩৬

ওমিক্রনের কারণে বিশ্বব্যাপী করোনার সুনামি শুরু হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশেও ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব চলছে। বাংলাদেশও ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বজুড়ে ওমিক্রনের কারণে সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তাকে সুনামির সঙ্গে তুলনা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচএ)। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির বিষয়ে সতর্ক করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. টেড্রোস আডানম গেব্রিয়াসিস। ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওমিক্রনকে জলোচ্ছ্বাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। 

করোনার সঙ্গে মানুষের লড়াই জীবন-মৃত্যুর। এ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সারা বিশ্বের চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা। বাংলাদেশের চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্য সেবা কর্মীরা মহামারীর দুই বছরে চিকিৎসা সেবা দিতে দিতে ক্লান্ত। করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুই শতাধিক চিকিৎসক ও কয়েক শত নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে তারা করোনা আক্রান্ত রোগীর যেভাবে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন তা প্রশংসনীয়। রোগীর চাপ সামলাতে সন্তান, পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। 

দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, দুই বছর করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা অভিজ্ঞ হয়ে গেছেন। তাই করোনা রোগীরা উপজেলা হাসপাতালেই সেবা নিলেই হবে। তাদের চিকিৎসা সেবার জন্য ঢাকায় আসার কোন দরকার নেই। শহরে চিকিৎসা নিতে আসতে আসতে করোনা রোগী অন্যকে সংক্রমিত করে। তাই চিকিৎসকরা গ্রামেই চিকিৎসা সেবা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু দেশে গ্রামাঞ্চলের সাথে শহরের চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থার পার্থক্য অনেক। অনেক জেলা-উপজেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত জনবল নেই। কোথাও সার্জন আছে, এনেসথেসিওলজিস্ট নেই। আবার কোথাও এনেসথেসিওলজিস্ট আছে সার্জন নেই। এমন অবস্থার মধ্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সময় থাকতে গ্রামাঞ্চলের সাথে শহরের চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থার পার্থক্য নিরসনসহ চিকিত্সা সেবা সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। 

বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের দাপটের মধ্যে বাংলাদেশেও দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচশ ছাড়িয়েছে। বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ৫০৯ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এক দিনে শনাক্ত রোগীর এই সংখ্যা ১১ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত একদিনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে সাত জনের, এই সংখ্যা এক মাসের বেশি সময় পর সর্বোচ্চ। কেউ বলতে পারে না করোনা কতদিন থাকবে। অনেকে বলেছিল দুই বছর থাকবে, অটো শেষ হবে। কিন্তু সব ধারনা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। করোনার কোন স্হায়ী ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। যে টিকা আছে তা নিলে মৃত্যু ঝুঁকি কম থাকে। দেশে এমনিতেই চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসক-নার্সের তীব্র সংকট। এর উপর বাড়তি যোগ হয়েছে করোনা। সরকার চিকিত্সা সেবা সক্ষমতা বাড়িয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় ঘটতি রয়েছে। চিকিত্সকদের ডিপিসির মাধ্যমে পদোন্নতি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। ডিপিসির মাধ্যমে পদোন্নতি হয় ৮০ ভাগ, আর পিএসসির মাধ্যমে পদোন্নতি হয় ২০ ভাগ। মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট রয়েছে। অনেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও পদোন্নতি পাচ্ছেন না। অথচ পদোন্নতি পেলে তারা প্রফেসার হতেন। 

করোনা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। কোথায় কী ঘাটতি আছে, জরুরি ব্যবস্হাপনা কী এসব আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে করোনা। কিন্তু এখনো যথাযথভাবে সব কিছু বাস্তবায়ন হচ্ছে না এক শ্রেণীর কর্মকর্তার অনভিজ্ঞতা ও ঘামঘেয়ালিপনার কারণে। যদিও নীতি-নির্ধারক মহল এসব দ্রুত সমাধান চান। সরকার ইতিমধ্যে চিকিত্সক-নার্সসহ জনবল নিয়োগ দিয়েছে-এতে গ্রামেই মানুষ চিকিত্সা সেবা পাবে। গ্রামে চিকিত্সক-নার্সদের বাসস্হানেরও ব্যবস্হা করেছে সরকার। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, যেভাবে ওমিক্রন ধেয়ে আসছে, তাতে স্বাস্হ্যবিধি মেনে এটা প্রতিরোধের কোন বিকল্প নেই। সবার মাস্ক পরতে হবে, স্বাস্হ্যবিধি মানতে হবে। আর ওমিক্রনে যেহেতু মৃদু উপসর্গ তাই এটার চিকিত্সা সেবা নেওয়ার জন্য গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার প্রয়োজন নেই। যে যেখানে আছেন, সেখানেই চিকিত্সা সেবা পাবেন। 

স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ওমিক্রন বিশ্বব্যাপী যেভাবে সুনামির মতো ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে অনেকে দিকবিদিক হারিয়ে ফেলছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়বে। আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ওমিক্রন বৃদ্ধি পাবে। তাই সময় থাকতে সচেতন হতে হবে। মাস্ক পরতে জেল-জরিমানা শুরু করা হবে। মাস্ক পরাসহ স্বাস্হ্যবিধি মেনে নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করুন। করোনা রোগীদের চিকিত্সার জন্য কারোর গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার দরকার নেই বলেও জানান তিনি। 

বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ওমিক্রনে সারাদেশে সুনামি শুরু হয়েছে। করোনার দুই বছরে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। ওমিক্রন প্রতিরোধ করতে সঠিক কৌশলগত পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রতিরোধে শতভাগ জনগোষ্ঠীকে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করতে হবে। সময় থাকতে সবার স্বাস্হ্য সচেতন হতে হবে। মাস্ক পরার পাশাপাশি হাত ধোয়া, দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে ৮০ ভাগ নয়, শতভাগ মানুষকে দুই ডোজ টিকাসহ বুস্টার ডোজ টিকা দিতে হবে। বয়স্কদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুই ডোজসহ বুস্টার ডোজ দিতে হবে। স্বাস্হ্য ব্যবস্হাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। জেলা-উপজেলায় হাসপাতালে জনবলসহ চিকিত্সা ব্যবস্হাপনাকে শক্তিশালী করতে হবে। জনসচেনতায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলে ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 

স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএম আজিজ বলেন, করোনাকালীন সময়ে সরকার ডাক্তার-নার্স নিয়োগ দিয়েছে। দিনরাত করোনা রোগীদের চিকিত্সা সেবা দিতে গিয়ে চিকিত্সক-নার্সরা ক্লান্ত। তবে চিকিত্সকরা মহান পেশায় আছেন, যতক্ষণ শারীরিক সুস্হতা আছে, ততোক্ষণ তারা সেবা দিয়ে যাবেন। নিয়মিত ডিপিসির মাধ্যমে চিকিত্সকদের পদোন্নতি হলে জেলা উপজেলায় শূন্য পদ পূরণ করা সম্ভব হতো বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। 

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন বলেন, ৬৪ জেলায় আইসিইউ স্হাপনের কাজ সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। সরকার সম্প্রতি ২৫০ জন এনেসথেসিওলজিস্ট নিয়োগ দিয়েছে। তারা উপজেলা পর্যায়ে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। জেলা হাসপাতালে আইসিইউ চালু হয়ে গেলে তারা সেখানে কাজ শুরু করবেন। এখানো প্রায় ৫০০ উচ্চতর ডিগ্রিধারী এনেসথেসিওলজিস্ট নিয়োগের অপেক্ষায় আছেন। সরকারি- বেসরকারি হাসপাতালে ২৫০০ এনেসথেসিওলজিস্ট রয়েছেন। তারা অপারেশন ছাড়াও আইসিইউ ও সিসিইউ ব্যবস্হাপনায় দায়িত্ব পালন করছেন। 

তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমাদের দুইটা হাত, একটি কাজ করলে, যদি অন্যটা অচল থাকে তাহলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। অনেক হাসপাতালে সার্জন আছেন, কিন্তু এনেসথেসিওলজিস্ট নেই। আবার এনেসথেসিওলজিস্ট আছেন কিন্তু সার্জন নেই, গাইনি বিশেষজ্ঞ নেই। গ্রামের মানুষ যাতে গ্রামে বসেই চিকিত্সা সেবা পান সেজন্য জরুরিভাবে উপযুক্ত জনবল নিয়োগ দিতে হবে। আর এ কাজটি সময় থাকতে করতে হবে। কারণ সংক্রমণ বেড়ে গেলে তখন সামাল দেওয়া কঠিন হবে।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি