ইস! সেই ছোটবেলার রসের পিঠার স্বাদ যেন মুখে লেগে আছে। প্রবীণ মানুষরা যখন এসব কথা বলেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা সেসব শুনে হাসে। হাসবারই কথা! এই ফাস্টফুডের যুগে পিঠার মজা তো পায়নি এখনকার প্রজন্ম। তার পরও হারিয়ে যেতে যেতে একেবারে মিলিয়ে যায়নি বাংলার পিঠা।
ফাস্টফুডের মতোই শহরের দোকানগুলোতে উঠে এসেছে পিঠা। ভাপা পিঠা তো শীতের সময় রাস্তার মোড়ে মোড়ে মেলে। আর নানান স্বাদের মসলা দিয়ে চিতই পিঠা খাওয়ার চলও নাগরিক জীবনে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু কতশত রকমের পিঠা যে রয়েছে, তার খোঁজ কি এই শহরে বসে পাওয়া যায়! যদিও-বা মেলে কনকনে শীতে গ্রামের বাড়ির মাটির দাওয়ায় বসে কাঁসার বাটিতে করে পিঠা খাওয়ার যে রোমান্টিক স্মৃতি—সেই ক্ষণ হারিয়ে গেছে একেবারেই। তা আর কখনোই ফিরে আসবে না। স্মৃতির পাতায় তার অবস্থান। তবে, হারিয়ে যেতে যেতে নাগরিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করেছে পিঠা। আয়োজন করা হচ্ছে পিঠা মেলার। এসব মেলায় দিন দিন মানুষের সমাগম বাড়ছে। গ্রামের সেই স্মৃতিকাতরতাময় আদল ভেঙে নতুন আঙ্গিকে পিঠা উঠে আসছে নাগরিক জীবনে।
পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে/ আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।
কবি সুফিয়া কামালের কবিতায় গ্রামবাংলার কিশোর বয়সের পিঠা খাওয়ার আনন্দ ধরা পড়ে এইভাবে। ‘ভাওয়াইয়া গানেও রয়েছে মানুষের পিঠা খাওয়ার বাসনার কথা — ‘মনটা মোর পিঠা খাবার চায়’।
সাধারণত নতুন ধান ওঠার পরে আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয় পিঠা। সব ঋতুতেই পিঠা তৈরি হয়। তবে শীতে খেজুর গুড় ও খেজুরের রসে ভেজা পিঠার স্বাদ ভোলা যায় না। সেজন্য শীতকালেই রকমারি পিঠা রয়েছে আমাদের সংস্কৃতিতে।
পিঠার নকশাগুলো খুব আকর্ষণীয়। নকশি পিঠা আমাদের লোকশিল্পের অংশ। অনেকে এটাকে মেয়েলি শিল্প নামেও অভিহিত করে থাকেন। পিঠার গায়ে বিভিন্ন ধরনের নকশা আঁকা হয়। রয়েছে পিঠার নকশা করবার নানা ধরনের ছাঁচ। পিঠাকে যখন এমনি নানা নকশায় রূপ দেওয়া হয় তখন তাকে বলে নকশি পিঠা। গ্রামের নারীদের শিল্পবোধের পরিচয় তুলে ধরে পিঠার ডিজাইন। এখন শিল্পীরা এই পিঠার ডিজাইন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের ছবিতে, ডিজাইনে ব্যবহার করছেন তা।
লোকজ ফর্ম নিয়ে নানা ধরনের কাজ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক শিল্পী শাবিন শাহরিয়ার। তিনি বললেন, পিঠাকে চাঁদ হিসাবে দেখা হচ্ছে, কখনো ফুল হিসেবে দেখেছে। বাংলাদেশের পিঠা লোকধারা এবং শিল্পের ক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী ফর্ম। বাংলাদেশকে চেনার জন্য উল্লেখযোগ্য একটি উপকরণ। গ্রামে জামাই এলে বা মেয়েরা বাড়িতে এলে পিঠার বানানোর রীতি রয়েছে। দেখা যায় এসব পিঠার ফর্ম প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয় থেকে নেওয়া। যেমন, মাছের ফর্ম, পান, কুলা, ফুল—এসব একেবারেই প্রকৃতি থেকে নেওয়া। নকশি পিঠার ক্ষেত্রে ফুল ও আলপনার কাজ প্রাধান্য পেয়ে এসেছে ঐতিহ্যগতভাবে। এসব পিঠা বানানোর যে ছাঁচ সেগুলো আমাদের গ্রামবাংলার মেয়েরা নিজেরা তৈরি করেন। কুশলী পিঠার ফর্ম তো আধখানা চাঁদের ফর্ম। এই ফর্মগুলো নিয়ে মেয়েরা তাদের নকশি কাঁথাতেও সুঁই-সুতোয় ফুটিয়ে তোলেন। আবার ঐ ফর্ম নিয়ে শিকড়সন্ধানী শিল্পীরা সেই ফর্মগুলোকে নিয়ে নতুন ফর্ম তৈরি করে। আমি এই ধরনের নকশি পিঠার ফর্ম নিয়ে কাজ করেছি।
পিঠা বেঁচে আছে নাগরিক মেলায় : পিঠা লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই, একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। হারিয়ে যেতে দেয়া চলবে না। আর সে কারণেই রাজধানীসহ বিভিন্ন স্হানে পিঠা মেলার আয়োজন বসে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের পিঠার সঙ্গে পরিচয় নেই বললেই চলে। সে পরিস্থিতি বিবেচনা করেই কয়েক বছর ধরে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে আয়োজন করা হচ্ছে পিঠা উত্সবের। শিল্পকলা একাডেমির সবুজ চত্বরে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নিয়মিতভাবেই বসেছে পিঠা উত্সব।
পিঠা উত্সব উদ্যাপন পরিষদের সদস্য সচিব খন্দকার শাহ আলম বললেন, ২০০৮ সালে যখন দেশে সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড স্হবির তখন পিঠা উত্সবের আয়োজন করা হয়। শিল্পকলা একাডেমির সবুজ প্রাঙ্গণে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় শুরু করা সেই উত্সব আট বছরে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এখন দল বেঁধে মানুষ আসে এ উত্সবে।
নানা রকমের পিঠা: শীতকালের পিঠা সবচেয়ে মজার। এ সময়ে খেজুরের রস ও আখের গুড় পাওয়া যায়। যা দিয়ে নানা স্বাদের পিঠা তৈরি হয়। পিঠার মূল মৌসুম শুরু হয় হেমন্তের, যখন কৃষকরা ঘরে ধান তোলেন। প্রত্যেক এলাকায় আলাদা ধরনের পিঠা রয়েছে। আবার একই ধরনের পিঠা এলাকাভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত। বিক্রমপুর বাহারি পিঠাঘরের স্বত্বাধিকারী নার্গিস আক্তার লীনা।
তিনি বললেন, বাসায় পিঠা বানাই। বিক্রমপুর অঞ্চচলের নানা ধরনের পিঠা বানাতে পারতাম। মানুষ খুব আগ্রহ নিয়ে সেসব পিঠা খায়। ভালো লাগে। শখের বশেই একবার এলাকার একটি মেলায় পিঠার স্টল দিয়েছিলাম। মানুষের সাড়া পাওয়ায় এখন বিভিন্ন মেলায় স্টল দেই। রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির মেলাতেও এখন প্রতি বছরই অংশ নিচ্ছি। এটা আমার ব্যবসা না। এমন কিছু পিঠা আছে যা সারাদেশেই প্রসিদ্ধ এবং জনপ্রিয়। এগুলি হচ্ছে এগুলি হচ্ছে ভাপা পিঠা, ঝাল পিঠা, ছাঁচ পিঠা, ছিটকা, চিতই, দুধ চিতই, বিবিখানা, চুটকি, চাপড়ি, চাঁদ পাকান, ছিট, সুন্দরী পাকান, সরভাজা, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা, পাকান, পানতোয়া, মালপোয়া, মালাই, মুঠি, আন্দশা, কুলশি, কাটা পিঠা, কলা পিঠা, খেজুরের পিঠা, ক্ষীর কুলি, গোকুল, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল, জামদানি, ঝালপোয়া, ঝুরি পিঠা, ঝিনুক, সূর্যমুখী, নকশি, নারকেল পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, নারকেলের সেদ্ধ পুলি, নারকেল জেলাফি, তেজপাতা পিঠা, তেলের পিঠা, তেলপোয়া, দুধরাজ, ফুল ঝুরি, ফুল পিঠা, বিবিয়ানা, সেমাই পিঠা প্রভৃতি। পিঠা তৈরির সাধারণ উপাদান হচ্ছে চালের গুঁড়া, ময়দা, গুড় বা চিনি, নারকেল ও তেল। অনেক সময় কিছু কিছু পিঠাতে মাংস ও সবজি ব্যবহার করা হয়। পাতায় মুড়িয়ে এক ধরনের বিশেষ পিঠা তৈরি হয়, যাকে পাতা পিঠা বলা হয়। কিছু কিছু পিঠার আকার অনুযায়ী নামকরণ করা হয়। যেমন বড় ধরনের পিঠাকে হাঁড়ি পিঠা এবং ছোট আকৃতির এক ধরনের পিঠাকে খেজুর পিঠা বলা হয়। বিয়ের সময় নতুন বরকে বরণ করা উপলক্ষে কারুকার্যখচিত, বর্ণাঢ্য ও আকর্ষণীয় নানা রকমের পিঠা তৈরি হয়। এ ধরনের পিঠার নাম বিবিয়ানা অর্থাৎ বিবি বা কনের পারদর্শিতা। এ ধরনের পিঠাকে জামাই ভুলানো পিঠাও বলা হয়। হাতের পরিবর্তে ছাঁচের সাহাঘ্যেও পিঠাকে নকশাযুক্ত করা যায়। ছাঁচগুলো সাধারণত মাটি, পাথর, কাঠ বা ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি। এসব ছাচের ভেতরের দিকে গাছ, ফুল, লতা, পাতা, মাছ, পাখি প্রভৃতির নকশা আঁকা থাকে।
জনপ্রিয় কিছু মোটিফ যেমন : পদ্ম, বৃত্ত ইত্যাদিও পিঠার নকশায় ব্যবহূত হয়। এছাড়া কখনো কখনো নকশি পিঠার গায়ে ‘শুভ বিবাহ’, ‘গায়ে হলুদ’, ‘সুখে থেকো’, ‘মনে রেখো’, ‘কে তুমি’, ‘ভুলোনা আমায়’ প্রভৃতি লেখার ছাপ দেওয়া হয়। পিঠায় বিচিত্র নকশা আঁকায় নৈপুণ্যের জন্য বৃহত্তর ময়মনসিংহের নারীদের খ্যাতি রয়েছে। আবার বৈচিত্র্যময় পিঠা তৈরিতে বরিশাল ও বিক্রমপুর অঞ্চলের মেয়েদের খ্যাতি রয়েছে। নকশার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পিঠার বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়। যেমন : শঙ্খলতা, কাজললতা, চিরল বা চিরনপাতা, হিজলপাতা, সজনেপাতা, উড়িয়াফুল, ভ্যাট ফুল, পদ্মদীঘি, সাগরদীঘি, সরপুস, চম্পাবরণ, কন্যামুখ, জামাইমুখ, জামাইমুচড়া, সতীনমুচড়া প্রভৃতি। পিঠার এ নামগুলো বিশেষ ভাবব্যঞ্জক।