বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে দেশের করোনার ভবিষ্যৎ। গত এক সপ্তাহে দেশে করোনা সংক্রমণ ১২৫ শতাংশ বেড়েছে। নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারায় দেশে গত এক দিনে শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা এক ধাক্কায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে ২২শ ছাড়িয়ে গেছে, সেই সঙ্গে দৈনিক শনাক্তের হার ছাড়িয়ে গেছে সাড়ে ৮ শতাংশ। এদিকে দেশে আরো নয়জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এ নিয়ে সরকারি হিসেবে মোট শনাক্ত ওমিক্রনের রোগী বেড়ে ৩০ জন হলো। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি।
গতকাল ওমিক্রন ঠেকাতে ১১ দফা বিধি-নিষেধের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। আগামী ১৩ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হবে। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত নভেম্বরে ১৫ দফা এবং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ১৬ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। সীমান্তবর্তী এলাকাসহ সব বন্দরে কি ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে, বর্ডার গার্ড ও ডিসি-এমপিদের কী ধরনের ভূমিকা রাখতে হবে- তার সবকিছু সেখানে উল্লেখ ছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি। স্থানীয় প্রশাসন বলছে তারা কোন নির্দেশনা পাননি। ভারত থেকে প্রতিদিন দুই সহস্রাধিক ট্রাক দেশে আসছে। সঙ্গে কয়েক হাজার লোকের যাতায়াত। ভারতে ওমিক্রনের সুনামি চলছে। কিন্তু ভারত থেকে আসা ট্রাক ড্রাইভার ও হেলপাররা স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, তাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে না। তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে না। তারা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে যেকোন সময় বাংলাদেশে ওমিক্রন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আশংকা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, ওমিক্রন ঠেকাতে যে ১১ দফা বিধিনিষেধ সরকার জারি করেছে, তা বাস্তবায়নে সকলকে আন্তরিক হতে হবে। এক্ষেত্রে ঢিলেঢালা ভাব ও সমন্বয়হীনতা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে দেশে করোনা পরিস্থিতি ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, শুধু আদেশ দিয়ে বসে থাকলে হবে না। আদেশ বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু চালু রাখা সম্ভব। ১১ দফা বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের ওপরই দেশের অর্থনীতি, মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করছে। এখানে ঢিলেঢালা ভাব দেখালে মহাবিপদ আসবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, করোনা মহামারি প্রতিরোধে গতকাল ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে সরকার। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুই দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এ কারণে সংক্রমণ প্রতিদিন বাড়ছে। গতকাল যে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছে এটি খুবই ভাল, আমরা এটাকে স্বাগত জানাই। তবে তা বাস্তবায়নে প্রশাসন কতটা আন্তরিক তার ওপর সংক্রমণের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে সকলকে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল হক বলেন, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নভেম্বরে আমরা ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলাম। ডিসেম্বরেও ১৬ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলাম। নির্দেশনা বাস্তবায়নে গাইডলাইনও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা কেউ মানেনি। স্বাস্থ্যবিভাগ শুধু নির্দেশনা দিতে পারে, বাস্তবায়নের দায়িত্ব অন্যান্য বিভাগের। না মানলে মহাবিপদ, মানলে মহাবিপদ থেকে রক্ষা পাবে। যারা নির্দেশনা কিংবা বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে না, তারাও কিন্তু সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে না। বাস্তবায়নে সকলের আন্তরিক হতে হবে, তাহলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। আইইডিসিআরের প্রধান উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। এখন বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে দেশের করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। জনসমাবেশ, পিকনিক, বিয়ে-শাদি এগুলো এখন বন্ধ রাখা উচিত। মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে সবাইকে। নইলে সংক্রমণ দ্রুত বাড়বে। তিনি বলেন, করোনাসহ যেকোন সংক্রমণের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি যত বেশি দ্রুত ছড়ায় ততো দ্রুত নিস্তেজ হয়ে যায়। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টও দ্রুত ছড়িয়ে এখন কমেছে। ওমিক্রনও দ্রুত কমে যাবে। তবে এখন সংক্রমিত করার সময়। তাই এখন সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, একই মাস্ক না ধুয়ে দুই দিন ব্যবহার করা যাবে না। অনেকে একটা মাস্ক দিনের পর দিন ব্যবহার করে আসছে। আবার একই মাস্ক একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করেন বলেও জানা গেছে। এক্ষেত্রে করোনাসহ যেকোন সংক্রমণ হওয়ার আশংকা শতভাগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২ হাজার ২৩১ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মৃতু্য হয়েছে ৩ জনের। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর একদিনে এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল, সেদিন ২ হাজার ৩২৫ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। আর দুই হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল সর্বশেষ ১৪ সেপ্টেম্বর। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ৯৩১ জনে। তাদের মধ্যে ২৮ হাজার ১০৫ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনা ভাইরাস। গত এক দিনে দেশে মোট ২৬ হাজার ১৪৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, তাতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা আগের দিন ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ ছিল। এর আগে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার এর চেয়ে বেশি ছিল। সেদিন প্রতি ১০০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৮ দশমিক ৬৫ জনের কোভিড পজিটিভ এসেছিল। করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটের সময় গতবছর জুলাই-আগস্ট সময়ে দৈনিক শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর তা নামতে নামতে জুলাই মাসে ২ শতাংশের নিচে চলে আসে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু এরমধ্যেই বিশ্বে শুরু হয় ওমিক্রনের ত্রাস। ৩ জানুয়ারি দৈনিক শনাক্তের হার ৩ শতাংশ এবং ৬ জানুয়ারি তা ৫ শতাংশ ছাড়ায়। সরকারি হিসাবে গত এক দিনে দেশে করোনা থেকে সেরে উঠেছেন ২০৮ জন। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৫১ হাজার ১১৩ জন সুস্থ হয়ে উঠলেন। এই হিসাবে দেশে এখন সক্রিয় কোভিড রোগীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৭১৩ জন, যা আগের দিন ১৪ হাজার ৬৯৩ জন ছিল।