বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

উজ্জ্বল নক্ষত্র রণজিত নিয়োগী 

আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৩৮

২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১টা ২০ মিনিটে ৭৫ বছর বয়সে একজন মানবতাবাদী, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কবি ও চিত্রশিল্পীর জীবনাবসানে শেরপুর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। শেরপুর জেলার প্রয়াত বিপ্লবী রবি নিয়োগী ও বিপ্লবী জ্যোৎস্না নিয়োগীর বড় পুত্র রণজিত নিয়োগী। প্রয়াত রবি নিয়োগী ময়মনসিংহ জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। কালাপানি খ্যাত আন্দামান জেলফেরত বিপ্লবী রবি নিয়োগী ব্রিটিশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বৈরাচারী শাসনামলে বিভিন্ন কারাগারে ৩৪ বছর ও ১১ বছর গৃহ?-অন্তরিন অবস্থায় কাটিয়েছিলেন। মাতা প্রয়াত জ্যোৎস্না নিয়োগী ৪৮ সালে ও ৫৪ সালে আট বছর কারাভোগ করেছেন। প্রয়াত রবি নিয়োগী, প্রয়াত জ্যোত্স্না নিয়োগী দুজনেই মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। পিতা-মাতার আদর্শে আজন্ম লালিত রণজিত অল্প বয়সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। মাতা প্রয়াত জ্যোত্স্না নিয়োগীর উদ্যোগ ’৫৪ সালে শেরপুর চকবাজার এলাকায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার গড়ে ওঠে। এই শহিদ মিনার নির্মাণ কমিটিতে প্রগতিশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে মাত্র ১২ বছর বয়সে রণজিত ও ছোট বোন মঞ্জুশ্রীও (লেখক) অংশ নিয়েছিলেন।

রণজিত শৈশবকাল থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন। তার কবিতা প্রথম ছাপা হয় ১০ বছর বয়সে বিদ্যালয়ের দেওয়াল পত্রিকায়। ১৯৫৯ সালে শেরপুর গোবিন্দ কুমার পিস মেমোরিয়াল বিদ্যালয় থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। চিত্র অঙ্কন বিষয়ে তার আগ্রহ দেখে তার পিতা-মাতা তাকে ঢাকায় সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। মেধা ও অধ্যবসায়ের গুণে রণজিত অল্প সময়েই শিল্পাচার্য প্রয়াত জয়নুল আবেদিন ও অন্যান্য শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। ১৯৬৩ সাল থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত তার লেখা কবিতা নিয়মিত ছাপা হতো আজাদ, সংবাদ, বাংলার বাণী প্রভৃতি দৈনিকের সাহিত্য পাতায় এবং বিভিন্ন সাহিত্য সংকলনে। ১৯৬৪ সালে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি সম্মানের সঙ্গে লাভ করে তিনি ১৯৬৬ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় চিফ আর্টিস্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

’৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের সময় অন্যান্য চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে থেকে বিক্ষুব্ধ চিত্র, কার্টুন অঙ্কন করে গণ-আন্দোলনকে বেগবান করার কাজে রণজিত নিয়োগী সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সেই বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞের নারকীয় দৃশ্যের চাক্ষুস সাক্ষী হয়ে রণজিত বহু কষ্টে হেঁটে নারায়ণগঞ্জে কাকা প্রকৌশলী প্রয়াত পরেশ গুপ্তের বাসায় পৌঁছান এবং সেখান থেকে বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে কলকাতায় যান। কলকাতায় পৌঁছে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ শাখার নেত্রী কমলা মুখার্জির বাসায় আশ্রয় নেন এবং বাংলাদেশ-সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি ও বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থায় চিত্রশিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। রণজিত বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চলের মানচিত্র এঁকে সেগুলো মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের হাতে পৌঁছে দিতেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বর গণহত্যার চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে কলকাতা আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ চিন্তামণি কর ও পটুয়া কামরুল হাসান বাংলাদেশের স্বনামধন্য চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে একটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত কলকাতার বিড়লা একাডেমিতে ‘ঊীযরনরঃরড়হ ড়ভ চধরহঃরহমং ধহফ উত্ধরিহমং নু অত্ঃরংঃং ড়ভ ইধহমষধফবংয’ শিরোনামে একটি চিত্রপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী সংগঠন ‘বাংলাদেশ-সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি’। এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন ভারতবর্ষের প্রখ্যাত ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী। এই প্রদর্শনীতে পটুয়া কামরুল হাসান, পাপেট শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, দেবদাস চক্রবর্তী, প্রাণেশ মণ্ডল, রণজিত নিয়োগী, বীরেন সোমসহ ১৭ জন চিত্রশিল্পীর ৬৬টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এই একই চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল এবং মানুষের মনে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির নিজ দায়িত্বে সাতটি চিত্রকর্ম বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। চিত্রগুলো সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টিদের হাতে তুলে দেন। সাতটি চিত্রকর্মের মধ্যে রণজিত নিয়োগীর আঁকা একটি চিত্রকর্ম রয়েছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রণজিত নিয়োগী শেরপুর ফিরে পিতা-মাতা ও বোনের সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত শেরপুরকে পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। শিশুদের মানসিক সুকুমার বৃত্তি বিকাশের সহায়তাকল্পে ‘পাতাবাহার’ নামে একটি শিশু সংগঠন ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শাখা গড়ে তোলার কাজে রণজিত নিয়োগী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে বিটিএমসিতে চাকরি নিয়ে রণজিত নিয়োগী চিফ ডিজাইনার হিসেবে কালীগঞ্জ মসলিন কটন মিল নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৭৮ সালের ৯ মে চাঁদপুর জেলার এক রাজনৈতিক সচেতন পরিবারের মেয়ে ছায়া সেনগুপ্তাকে রণজিত নিয়োগী বিবাহ করেন। এ সময় রণজিত চিত্রশিল্পী হাশেম খান, শিশুতোষ গ্রম্হ রচয়িতা আখতার হুসেনসহ অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তির বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণের কাজ করেছেন। ১৯৮৪ সালে মসলিন কটন মিল ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাওয়ার পর তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য শেরপুর চলে আসেন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ জাতীয় কবিতা পরিষদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বিপ্লবী রবি নিয়োগী স্মৃতি পরিষদ প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। রণজিত নিয়োগী ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ, নিষ্ঠাবান, আত্মাভিমানী এক জাতশিল্পী ও আত্মমগ্ন কবি। রণজিত নিয়োগী তার সৃষ্টির সঙ্গে মানুষের মধ্যে আজীবন বেঁচে থাকবেন। রণজিত নিয়োগীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে এই প্রত্যাশা।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন