শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দারসবাড়ি: দেশের প্রাচীনতম ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়

আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২২, ১১:৩২

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ছোট সোনামসজিদ ও কোতোয়ালি দরজার মধ্যবর্তী স্থানে ওমরপুরের সন্নিকটে অবস্থিত বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির উল্লেখযোগ্য হলো দারসবাড়ি মাদ্রাসা, মসজিদ। মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষে ৩ কিলোমিটার দূরে বিজিবির সীমান্ত তল্লাশি চৌকি পেরিয়ে আরো কিছুদূর হেঁটে আমবাগানের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেই দারসবাড়ি মাদ্রাসা, মসজিদ।

আরবি দরস বা দারস অর্থ পাঠ, উচ্চারণ বিকৃতিতে শব্দটি হয়ে যায় দারাসবাড়ি বা দারসবাড়ি মসজিদ, মাদ্রাসা। স্বাধীন বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের রাজত্বকালে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে ১ রমজান সুলতানের আদেশে অখণ্ড বাংলার আদি রাজধানী গৌড়ের ফিরোজপুরের দারসবাড়িতে একটি সুবিশাল আবাসিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদ্রাসাটি পাঠক্রম ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় ছিল একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়তুল্য। বাংলাদেশে সন্ধানপ্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হলো এই দারসবাড়ি। বিভিন্ন জনপদ থেকে শিক্ষার্থী শিক্ষার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হতেন। এখানেই প্রথম সিহাহ সিত্তাহর সমন্বিত পাঠক্রমের সূচনা হয়। এখানেই মুহাম্মদ বিন ইয়াজদান বখশ নামের একজন বুজুর্গ আলিম নিজ হাতে বুখারি শরিফ লিপিবদ্ধ করেন এবং তিনিই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন। যদিও ঢাকার সোনারগাঁওয়ে শায়খ শারফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (মৃ. ৭০০ হি. ১৩০০ খ্রি.) প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হাদিসের আনুষ্ঠানিক পাঠদান শুরু করেন। দীর্ঘদিন দারসবাড়িতে মসজিদ, মাদ্রাসা মাটিচাপা অবস্থায় পড়ে ছিল। ছিল চারপাশ গাছগাছালিঘেরা, পরিত্যক্ত ভূতুড়ে জনপদ। সত্তরের দশকের প্রথম ভাগে খনন কাজের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয় দারসবাড়ি মাদ্রাসা, মসজিদ। মূলত এলাকাটি ছিল একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় কমপ্লেক্স। সুপ্রাচীন এই ইসলামি স্থাপত্য নিদর্শনটি ছিল বর্গাকৃতির। সবগুলো বাহুর দৈর্ঘ্য ৫১.৫২ মিটার। কমপ্লেক্সের মাঝামাঝি অংশে ৩৭.৫ মিটার পরিমাপের বর্গাকার চত্বরের পশ্চিম বাহু ছাড়া অপর তিন বাহুতে এক সারি করে প্রকোষ্ঠ এবং তিন বাহুর মধ্যবর্তীতে ছিল তিনটি নামাজের জায়গা বা ইমামের কক্ষ। তিনটি কক্ষেই রয়েছে আলাদা আলাদা তিনটি অবতল মেহরাব। স্থাপনাগুলোর দেওয়াল পোড়ামাটির ফলক ও নকশায় অলংকৃত। দারসবাড়ি কমপ্লেক্সে আরো ৩৭টি কক্ষ ছিল। ছিল ওয়াক্তিয়া মসজিদ একটি, অফিস একটি। ছিল তিনটি প্রবেশপথ। বাহ্যিকভাবে দারসবাড়ি ইসলামি কমপ্লেক্স বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্ষ সংখ্যা ৪০টি হওয়ার কারণে, দারসবাড়িকে চল্লিশ ঘর বা চল্লিশ বাড়িও বলা হতো।

দারসবাড়ি মসজিদের কাঠামো এখনো দাঁড়িয়ে থাকলেও ধসে গেছে ছাদ, গম্বুজ ইত্যাদি। নেই নামাজ আদায়ের পরিবেশ। ভগ্ন দেওয়াল ও ভূগর্ভস্থ ভীত প্রমাণ করছে, একদা এ অঞ্চলে ছিল সুশিক্ষিত আধুনিক মুসলিম সভ্যতার সূতিকাগার। ভূকম্পন, অন্য কোনো প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক কারণে হারিয়ে যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব।

পরিশেষে বলতে হয়, শহিদ-গাজি, দরবেশ, বিজেতা, ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্বের আগমনে ইসলাম বাংলাদেশের গ্রাম ও বিজন প্রান্তরে ছড়িয়ে গেছে। তারা ঘুমিয়ে আছেন এ দেশেরই পবিত্র মাটিতে। এমনি বাস্তবতার সাক্ষী দারসবাড়ি। বর্তমানে বিধ্বস্ত, প্রায় বিলুপ্ত। কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত শিলালিপি মোতাবেক মসজিদটি ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দিন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ্ নির্মাণ করান। আমরা কি পারি না, পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারসবাড়ির ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিচাপা ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড় করাতে নতুন আরেক দারসবাড়ি মসজিদ, মাদ্রাসা।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আবারও নতুন জীবন পেতে পারে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব। কেননা, ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যখ্যাত ৭ম শতাব্দী থেকে আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকা নালন্দা মহাবিহার ছিল ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৫১ সালে নালন্দা মহাবিহার ফিরে পায় তার হারানো ঐতিহ্য ও সজীবসত্তাগত অস্তিত্ব। ২০০৬ সালে নালন্দা মহাবিহার একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়। অর্থাৎ শিবগঞ্জের দারসবাড়িতে একটি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর।

ইত্তেফাক/এমআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন