শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রাশিয়া কেন কাজাখস্তানে সৈন্য পাঠাল 

আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৪:০২

প্রতিবেশী কাজাখস্তানের পতনোন্মুখ একনায়ককে বাঁচাতে ট্রাকভর্তি সৈন্য পাঠিয়েছে রাশিয়া। কাজাখস্তানের রাজনৈতিক পরিস্হিতি হঠাত্ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার পর দ্রুত সাড়া দিয়েছে মস্কো। সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন ও সিরিয়ার মতো কোনো কোনো দেশে সৈন্য পাঠালেও কাজাখস্তানে এই সময় সৈন্য পাঠানোর বিষয়টি অনেকেই ধারণা করেনি। বিশ্লেষকরা এর পেছনে মস্কোর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুমান করছেন।

যে কোনো দেশ যখন অন্য কোনো দেশে সৈন্য পাঠায় তখন প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সেগুলো হিসাব করেই সেটা করে। যেমন বিদেশের মাটিতে কিছু স্হানীয় লোকের সমর্থন যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি জনগণের একটি অংশের বিরোধিতারও মুখে পড়তে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনার মুখে যেমন পড়তে হবে, একই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞারও ঝুঁকি রয়েছে। কাজেই সামরিক হস্তক্ষেপের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মূল্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হিসাব। আগ্রাসনকারী যে কোনো দেশ এগুলো বিবেচনা করেই তা করে। বিশেষ করে, ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপের জের রাশিয়া এখনো টেনে চালাচ্ছে। এমতাবস্হায় দেশটি নতুন করে কোথাও সামরিক অভিযান চালাবে তা সংগত কারণেই প্রত্যাশিত ছিল না।

উল্লেখ করা যেতে পারে, মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ১৯৯২ সালের মে মাসে কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সিএসটিও নামে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তি হয়েছিল। অতি সম্প্রতি কাজাখস্তানে রুশ সৈন্য প্রেরণের ঘটনাটি ঐ চুক্তির আওতায় হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে কাজাখস্তানে জনগণ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ২ জানুয়ারি এই বিক্ষোভ চরমে পৌঁছে, ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এই বিক্ষোভ মূলত রাজনৈতিকের সঙ্গে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত ছিল না। কিন্তু মস্কোর নীতিনির্ধারণী মহল ধারণা করে থাকতে পারে যে, রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো এলাকা জুড়ে।

রাশিয়ার কাজাখস্তানে সৈন্য পাঠানোর ঘটনার সঙ্গে ২০১৪ সালে ইউক্রেন বা ২০০৮ সালে জর্জিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের সঙ্গে ঠিক তুলনা করা যায় না। কারণ জর্জিয়া বা ইউক্রেন সিএসটিও চুক্তিভুক্ত ছিল না। সামরিক মৈত্রী চুক্তি আছে, এমন কোনো দেশে রাশিয়ার সৈন্য পাঠানোর ঘটনা এটাই প্রথম। সিএসটিও চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আছে আর্মিনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান। কাজাখ প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমরাত তোকায়েভের পক্ষ থেকে অনুরোধ আসার পর মস্কো সেখানে সৈন্য পাঠায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে উদ্ভূত জনবিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর কাজাখ সরকার সেই অনুরোধ করে। বিক্ষোভ শুরুর পর পরিস্হিতি সরকারের প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যে কারণে তোকায়েভ সিএসটিওর আওতায় রুশ সামরিক সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করেন। রাজধানী আলমাটিসহ বড় শহরগুলোর এয়ারপোর্ট ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে রুশ বাহিনী। লক্ষণীয় বিষয় বহুপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি হওয়ার ৩০ বছর পর এর প্রথম প্রয়োগ ঘটল।

তবে মস্কোর সর্বসাম্প্রতিক এ পদক্ষেপ কেবল কাজখস্তানের রাজনৈতিক স্হিতিশীলতা বজায় রাখা যায় কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্ন কথা বলছেন। এ ঘটনাকে জর্জিয়া বা ইউক্রেনের সঙ্গে ঠিক তুলনীয় নয়। সোভিয়েত-পরবর্তী জমানায় রুশ সামরিক হস্তক্ষেপের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। দেশের ভেতরে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্হানে নেই। বিরোধীদের ওপর দমন পীড়নসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ সময়ে বিদেশের মাটিতে সৈন্য পাঠানো দেশের ভেতরের জনমতকে তার পক্ষে রাখার একটি কৌশল হতে পারে। তিনি হয়তো এটি দেখাতে চাইবেন যে, বৈরী প্রতিবেশী ও পশ্চিমাদের মোকাবিলায় তারা প্রস্ত্তত আছেন।

জর্জিয়া ও ইউক্রেনে পশ্চিমাপম্হি শাসকরা ক্ষমতায় ছিল। তাদের ভিত ধসিয়ে দেওয়া ছিল রাশিয়ার আগেকার সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য। কিন্তু কাজখস্তানে সোভিয়েত পতনের পর থেকে রুশপম্হি নাজারবায়েভ ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি এখন প্রেসিডেন্ট পদে না থাকলেও তার অনুগ্রহপুষ্ট তোকায়েভ সেই পদটিতে আছেন। বিক্ষোভের মুখে তোকায়েভ ক্ষমতা ছাড়লেও সেখানে রুশবিরোধী কোনো শক্তি যেন ক্ষমতায় না আসে, মস্কো সেটি নিশ্চিত করতে চাইছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র বেলারুশ ও আর্মেনিয়াতেও সময় সময় রাজনৈতিক অবস্হা উত্তাল হয়ে ওঠে। সিএসটিও চুক্তির আওতায় ঐ দুটি দেশে কেন কখনো সৈন্য পাঠানো হয়নি। কাজাখস্তানে এখন রাশিয়া যে দৃষ্টান্ত স্হাপন করল, তার সুযোগ ঐ দেশ দুটির রাজনৈতিক অস্হিরতা নতুন করে মাথাচাড়া দিতে পারে।

ইত্তেফাক/টিআর