শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অনাগ্রহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের

আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০৭:৩৮

করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দুই সপ্তাহের জন্য স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। সরাসরি পাঠদান বন্ধ হওয়ায় বিকল্প হিসেবে অনলাইনে পাঠদান চালু রাখার নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু এই পাঠদানে আগ্রহ কম শিক্ষার্থীদের। আগ্রহ তৈরি হয়নি শিক্ষকদেরও। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর শিক্ষা বিভাগের তদারকিও নেই।

২০১৯ সালের মার্চ থেকে ১৭ মাস বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই দীর্ঘ ছুটি শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পাঠদানের উদ্যোগ নেয় সরকার। অনলাইনের পাঠদানের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টাও করা হয়। এসব বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। অনলাইনে শিক্ষার পরিধি বাড়ানোর জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

অনলাইন শিক্ষার মূল শর্ত হলো সব শিক্ষার্থীর জন্য ইন্টারনেট এবং অনলাইনে কোর্সের ডকুমেন্ট নিশ্চিত করা। এ দুটির ক্ষেত্রেই ছিল সমস্যা। শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন কোর্সের ডকুমেন্ট শিক্ষার্থীদের উপযোগী নয়। কিন্তু এত দিনেও সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। অনলাইন পাঠদানে গত দুই বছরেও কোনো উন্নতি হয়নি।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী ল্যাপটপ, ইন্টারনেটের অভাবে ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। এবারও পারবে না। ফলে এরা বরাবর পিছিয়েই থাকবে। গ্রাম ও পার্বত্যাঞ্চলে আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাব রয়েছে, যা অনলাইন শিক্ষার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। অনলাইন শিক্ষার জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসংযোগ। এসব কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে একধরনের বৈষম্য।

নজরুল আমিন নামে এক অভিভাবক বলেন, শিক্ষার্থীরা স্কুলের টিউশন ফি দিচ্ছে। আবার টাকা দিয়ে মোবাইল ডাটাও কিনছে। করোনাকালে আর্থিক দৈন্যতা বেড়েছে। এর পরও এত ব্যয় কীভাবে করবে সাধারণ মানুষ। শিক্ষার্থীদের যে অনলাইনে পড়াশোনায় আগ্রহ নেই তা বিগত সময়ের কয়েকটি মাঠ জরিপের তথ্যেই ফুটে উঠেছে। খোদ শিক্ষা অধিদপ্তরের এক জরিপেই তুলে ধরা হয়েছে, মাধ্যমিকের ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অনুপস্থিত আর করোনাকালে ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী সংসদ টিভিতে প্রচারিত ক্লাসে আগ্রহ দেখায়নি। ২৯ শতাংশ বিদ্যালয় অনলাইন ক্লাসের উপস্থিতির তথ্য সংরক্ষণ করেনি। উপস্থিতির তথ্য-বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত ছিল।

এর আগে গত বছরের শুরুতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান গণস্বাক্ষরতা অভিযানের একটি গবেষণায় দেখানো হয়, দূর-শিক্ষণে (সংসদ টিভি, অনলাইন, রেডিও ও মোবাইল ফোন) প্রক্রিয়ায় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে, ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ অংশগ্রহণ করেনি; যেসব শিক্ষার্থী দূর-শিক্ষণ প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছে, তাদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ ডিভাইসের অভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। গ্রামীণ এলাকায় এই হার ৬৮ দশমিক ৯ শতাংশ।

রাজধানীর মিরপুরের একটি প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক অনলাইনে লাইভ ক্লাস নিয়েছিলেন। ঐ শিক্ষক জানান, ৮০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র এক জন শিক্ষার্থী ঐ ক্লাস দেখেছে। অপর একজন শিক্ষক পূর্ব ঘোষণা দিয়ে জুম ক্লাস নিয়েছিল। সেখানেই মাত্র দুই জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। অথচ ঐ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ছিল ৭৮ জন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক পর্যায়ে সংসদ টিভির মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। ক্লাসের গুণগত মান ও তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও টিভিতে প্রাথমিকের ক্লাস চালু করেছে। যদিও প্রান্তিক জনপদে সবার ঘরে টিভি নেই। আবার যাদের টিভি আছে তারাও মাঝে মাঝে বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে সঠিকভাবে ক্লাসে যোগদান করতে পারছে না। সংসদ টিভিতে এই পাঠদান চলে। কিন্তু সবার জন্য এ সুযোগ নেই। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কী পদক্ষেপ নেবে এটাই এখন দেখার বিষয় বলছেন আমিনুল ইসলাম নামের এক শিক্ষক।

আরিফুল হক নামে এক শিক্ষক বলেন, করোনা সংক্রমণ আবারও বাড়বে; বন্ধ হতে পারে স্কুল-কলেজ। আগামী কয়েক বছর ধরে চলতে পারে এই সংক্রমণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে এত তথ্য থাকার পরও অনলাইনে শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে, কম মূল্যে বা বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা দিতে কোনো কার্যক্রম হাতে নেয়নি। এটাই আমাদের দেশের জন্য দুর্ভাগ্য।

যে শিক্ষার্থী ২০১৯ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। মাত্র কয়েক দিন স্কুলের ক্লাসরুমে পা রেখেছিল। এরপর আর স্কুলে যেতে হয়নি। সে এখন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থী আবার কবে স্কুলে যাবে—এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না কেউ।

ইত্তেফাক/এমআর