শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

 দুই সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস হঠাৎ বন্ধ

আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:৫৮

কোন ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই দুই সরকারি হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস হঠাত্ বন্ধ রাখায় রোগীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। গতকাল বুধবার আগারগাঁওয়ে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস বন্ধ ছিল। এতে রোগীদের ক্ষুব্ধ স্বজনরা বিক্ষোভ করেন। এক পর্যায়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিলের টাকা পরিশোধের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে সাত ঘণ্টা পর আবার চালু করা হয় কিডনি ডায়ালাইসিস। 

পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)-এর আওতায় একটি বেসরকারি কোম্পানি জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিসের কাজ পায় ২০১৫ সালে। ২০১৬ সাল থেকে তারা কাজ শুরু করে। দুইভাবে ডায়ালাইসিস করা হয়। একটি কম মূল্যে ও আরেকটি বেশি মূল্যে। কম মূল্যে ডায়ালাইসিস করেন দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা। আর বেশি মূল্যে ডায়ালাইসিস করেন উচ্চবিত্ত কিংবা যাদের সামর্থ্য আছে তারা। কিন্তু ২১ কোটি টাকার বিল আটকে আছে দাবি করে গতকাল কিডনি ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেয় ঐ বেসরকারি কোম্পানি। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ হোসেন বলেন, বিনা নোটিশে তারা কিডনি ডায়ালাইসিস বন্ধ করেছে। অর্থাৎ তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তিনি বলেন, ২১ কোটি টাকার বিল সঠিক নয়। তাদের বিল আরো অনেক কম। নিয়মিত তাদের বিল দেওয়া হচ্ছে। তারা দুটি বিল জমা দিয়েছে। এর মধ্যে গতকালও তাদের ৫ কোটি ১০ লাখ টাকার বিল পাশ হয়েছে। আর তিন কোটি ২৪ লাখ টাকার বিল পাশের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। অপরদিকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অনুরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সেখানেও কিডনি রোগী ও তাদের স্বজনরা বিক্ষোভ করেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, কিডনি ডায়ালাইসিস হল মানুষের জীবন রক্ষার ব্যবস্থা। এটা বন্ধ কিংবা বিলম্ব করা অমানবিক। সরকারি হাসপাতালে দরিদ্ররা ফ্রি চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য যান। তাই যারা উচ্চবিত্ত কিংবা যাদের সামর্থ্য আছে তাদের সরকারি হাসপাতালে সংযুক্ত করা উচিত হয়নি। কারণ বেসরকারি হাসপাতালই কিডনি ডায়ালাইসিসের ব্যবস্হা রয়েছে। সেখানে তারা সেই ব্যয়ভার বহন করতে পারেন। কিডনি ডায়ালাইসিস বন্ধ করার আগে অবশ্যই নোটিশ করা উচিত ছিল। কিন্তু এটা না করে ভয়ঙ্কর কাজ তারা করেছে। এর দায়ভার স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি ঐ কোম্পানির।

দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কোন না কোনভাবে কিডনি রোগে ভুগছে। আর আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ হাজার রোগীর কিডনি পুরোপুরি অকেজো হচ্ছে প্রতিবছর। এ ধরনের রোগীর জন্য মাত্র দুই রকম চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। একটি হলো ডায়ালাইসিস এবং অপরটি কিডনি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই দুই ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতিই ব্যয় বহুল। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে কিডনি ডায়ালাইসিস করে আসছেন দরিদ্র রোগীরা। পাবলিক প্রাইভেট  পার্টনারশিপ (পিপিপি)-এর আওতায় একটি কোম্পানি ২০১৬ সাল থেকে ঐ দুই সরকারি হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস করে আসছে।

বিশিষ্ট কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নিজামউদ্দিন চৌধুরী বলেন, কিডনি ডায়ালাইসিস বন্ধ করার আগে সরকারকে লিখিত নোটিশ করে সময় দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে কোন ধরনের নোটিশ ছাড়া কিডনি ডায়ালাইসিস বন্ধ করা অমানবিক। এতে রোগীর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

রাজধানীর জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করে দেওয়ায় রোগীর স্বজনরা গতকাল শেরে বাংলা নগরে এ হাসপাতালের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। ফলে মিরপুর সড়কে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়। রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আল আমিন বারী সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিস নিতে এ হাসপাতালে আসেন। কিন্তু গতকাল এসে জানতে পারেন, ডায়ালাইসিস বন্ধ । কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, সংশ্লিষ্টরা বলেছে, সরকারের কাছ থেকে টাকা না পাওয়ায় এটি বন্ধ রয়েছে। গত ১৩ বছর ধরে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হয় আল আমিন বারীকে। তিনি বলেন, তার যখন ডায়ালাইসিস নিতে দেরি হয়, তখন শ্বাসকষ্ট অনেক বেড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ডায়ালাইসিস করাতে না পারলে রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে বেশি। জসিম উদ্দিন লিটন নামে আরেকজন রোগী বলেন, ‘কিছু দিন পরপরই এরা টাকার জন্য ডায়ালাইসিস বন্ধ রাখে। তাতে আমাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।’

জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাসপাতালের নিয়মিত রোগীদের ডায়ালাইসিসের বিল বাকি নেই। করোনা ভাইরাসের কারণে অন্যান্য হাসপাতাল থেকেও এই হাসপাতালে এসে ডায়ালাইসিস করিয়েছে অনেক রোগী। অতিরিক্ত রোগীর জন্য যে বিল হয়েছে, সেটা বাকি আছে।’ কোভিডের কারণে কুর্মিটোলা ও মুগদা হাসপাতাল থেকেও রোগী এসেছে জানিয়ে পরিচালক বলেন, ‘এ জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে, সেটা তারা চাচ্ছে। এই টাকাও তারা পেয়ে যাবে, কিছুটা সময় দরকার। দেশে কিডনি রোগের সবচেয়ে বড় এই বিশেষায়িত হাসপাতালে একজন রোগীর একবার ডায়ালাইসিস নিতে দুই হাজার ৭০০ টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে রোগীর কাছ থেকে নেওয়া হয় ৫১০ টাকা। বাকি টাকা হাসপাতাল বহন করে। সপ্তাহে সোমবার এবং বুধবার কম টাকায় ডায়ালাইসিস করানো যায় এই হাসপাতালে। ’

চট্টগ্রাম অফিস জানায়, চট্টগ্রাম মেডিক্যালে বকেয়া টাকা না পাওয়ায় হঠাত্ করে কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করে দিয়েছে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। এতে সেবা নিতে আসা রোগীরা চরম ভোগান্তিতে পড়ে। এতে ক্ষুব্ধ রোগীরা বিক্ষোভ করতে থাকেন। প্রায় ৮ ঘন্টা ডায়ালাইসিস বন্ধ থাকে। পরে চমেক হাসপাতালের পরিচালক বকেয়া পরিশোধের আশ্বাস দিলে সেবা কার্যক্রম পূণরায় শুরু হয়। বেসরকারি একটি কোম্পানি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিজ তলায় ডালাইসিস সেবা দিয়ে থাকেন। এই সেন্টারে ৩২টি ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে। একজন রোগী ৫১০ টাকায় ডায়াইলাইসিস সেবা পেয়ে থাকেন। এতে প্রতি রোগীর পিছনে সরকার ২ হাজার ৮৫ টাকা ভর্তুকি দিয়ে থাকে। নগরীসহ আশপাশের জেলা থেকে প্রতিদিন অসংখ্য কিডনি রোগী ডায়ালাইসিস করতে আসেন এই সেন্টারে। গতকালও প্রায় ৪০ জনের মতো রোগী ডায়ালাইসিস করতে আসেন। গতকাল পূর্বঘোষণা ছাড়া ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েন রোগীরা। এ সময় ক্ষুদ্ধ রোগীর স্বজনরা বিক্ষোভ শুরু করে। 

প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক হিমেল আচার্য বলেন, ‘গত পাঁচ বছর ধরে আমরা ঢাকা ও চট্টগ্রামে ডায়ালাইসিস সেবা পরিচালনা করছি। এই সেবা দিতে গিয়ে আমরা বিপুল পরিমাণ বকেয়া পাওনা রয়েছি। আমাদের অথ ‌র্সংকটে কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিদিন আমাদের ৬ লাখ টাকা করে দেনা বাড়ছে। টাকা না পেলে আমরা কিভাবে সেবা দিবো। টাকা পরিশোধের আশ্বাসে আমরা সেবা পুনরায় চালু করেছি।’ 

হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামীম হাসান বলেন, প্রকিষ্ঠানটি কিছু টাকা বকেয়া থাকায় সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। বকেয়া টাকা পরিশোধ করা সাপেক্ষে তারা আবার সেবা চালু করেছে। কয়েক দিনের মধ্যে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে।’ 

ইত্তেফাক/ আরাফাত