বালকটি তখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ওপরের শ্রেণির ছাত্ররা কালো ব্যাজ পরে সবাইকে বিদ্যালয় মাঠে জড়ো করিয়েছে। এর একদিন আগে, মানে ২১ ফেব্র‚য়ারি ঢাকায় মায়ের মুখের ভাষার জন্য লড়াই করে প্রাণ দিয়েছেন সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ আরো অনেকে।
এরই প্রতিবাদে মিছিল নিয়ে থানা সদরে যেতে হবে। সেই বালকও প্রস্ত্তত। এমনিতে সে কড়া নজরদারির মধ্যে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে। এর জন্য নিয়োজিত নির্দিষ্ট লোক আছেন। বালক মিছিলে যাবে, তাই ঐ লোককে বিদায় দেওয়া হলো। থানা-সদর সাড়ে তিন মাইলের পথ, খালি পায়ে হেঁটে যেতে বালকের কোনো কষ্টই হয়নি। আগুনমুখো দুপুরের নিষ্ঠুর রোদ মাথায় করে আবার ফিরল নিজেদের বিদ্যালয়-মাঠে। বালক তো একা বাড়ি ফিরতে পারবে না, পথ চেনে না। বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক তাকে বাড়ি পৌঁছে দেন। বালকের বুক ঢিপঢিপ করছে, নিশ্চয়ই বাবা-মার বকুনি খেতে হবে!
সেই বালক, পরিণত বয়সে তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায় সেদিনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, এর থেকে উদ্ধৃত করছি—‘... মা বরং আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, কোনো দোষ করিসনি, ঠিক করেছিস। বাবার নীরব সায় লক্ষ করেছি মা’র কথায়। জীবনে প্রথম স্বাধীনতার ব্যবহার বাবা-মার কাছে যথার্থ বিবেচিত হওয়ায় আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। সেই আমার স্বাধীনতার প্রথম সঠিক ব্যবহার।’
হতে পারে এটি একটি সাধারণ গল্প। কিন্তু এর অন্তর্গত আলো এবং শক্তিটি কিন্তু প্রসারিত, প্রজ্জ্বলিত। শৈশবের এমন আরো কিছু ঘটনার বিশ্লেষণে বালকটির মনোজগত্ গঠনের একটি আভাস কিন্তু পাওয়া যায়।
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ যে বালকটির গল্প আপনাদের শোনালাম, তাঁর নাম রফিকুল ইসলাম খান, পরবর্তীকালে তিনি পরিচিতি লাভ করেন রফিক আজাদ নামে—বাংলাভাষার বিশিষ্ট কবি। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া, রফিক আজাদ সারা জীবন কবিতাই লিখেছেন। তিনি বলতেন, কবিতা একটি জীবন দাবি করে। তিনি সারা জীবন শব্দ-ছন্দের সৌন্দর্য-সাধনায় এ সত্যটুকু প্রমাণ করে গেছেন। ‘কবির কর্তব্য হলো/খুব দ্রুত শাদা পাতাগুলো/ ভ’রে ফেলা!’ এ-ই ছিল কবি রফিক আজাদের ব্রত।
সশব্দ আশ্চর্য এক সুন্দরের নাম রফিক আজাদ। চেতনার স্বচ্ছ বিস্তৃতির ধারাবাহিকতায় এই কবি যত ঝুঁকিবহুল হোক, কদর্যকে কদর্য আর সুন্দরকে সুন্দর বলায় কখনো কুণ্ঠাবোধ করেননি। পিতামহর আমল থেকেই রফিক আজাদরা রাজনৈতিক পরিবার। তাঁর দাদা নঈম উদ্দিন খান ছিলেন কংগ্রেসের সর্বক্ষণিক কর্মী। রফিক আজাদ নিজে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। কিন্তু ছিলেন রাজনৈতিক-সচেতন মানুষ। দেশ, দেশের মানুষ, মানুষের অধিকারের প্রশ্নে তাঁর অবস্হান ছিল দৃঢ়, স্বচ্ছ এবং নিরাপস। বহু কবিতায়, কবিতার বহু স্হানে একজন সংবেদনশীল কবিকে শনাক্ত করা যায়।
রফিক আজাদ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘... এক স্বাধীন সিদ্ধান্ত আমাকে মাথা-উঁচু রাখতে এখনো সাহাঘ্য করে। সেটি ১৯৭১ সালে।’ কবির মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ একটি বিশেষ তাত্পর্য বহন করে। মুক্তির মহান যুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন, পরবর্তী সময়ের ঘটনাসংকুলতা কবির চোখে বিচিত্র মাত্রায় ধরা পড়েছে। তাঁর অনেক কবিতায় আমরা ভিন্ন মাত্রিক কাব্যচেতনার উদ্ভাসন লক্ষ করে থাকি।
বাংলাভাষার বিশিষ্ট কবি হিসেব স্বীকৃত রফিক আজাদের কাব্য-বিকাশ-পর্বটা গত শতাব্দীর ষাটের দশক। এই দশকটি সারা পৃথিবীর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্যও। পুরনো প্রথার অতিক্লান্িত কাটিয়ে নতুন চেতনালোকে তারুণ্যের বিজয় যেমন বিশ্ববাসীর আকাঙ্ক্ষা ছিল, বাংলাদেশেও ঘটেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ। শোষণমুক্তি আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার হচ্ছিল। রাজনৈতিক চেতনার সমান্তরালে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চেতনাও শাণিত হচ্ছিল। ষাটের দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যান্দোলনে সংঘবদ্ধ একটি ‘বিদ্রোহ’ সংগঠিত হয়েছিল। ‘স্যাড জেনারেশন’ নামে সেই সময়ের তরুণ কবি-লেখকরা যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, এর অগ্রভাগে ছিলেন রফিক আজাদ। তাঁরা প্রকাশ করেছিলেন ‘স্বাক্ষর’ নামক একটি অভিনব ‘ছোট কাগজ’। প্রথম সংখ্যা বেরনোর পর সাহিত্যমহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়, বিতর্কের ঝড় ওঠে। সাকুল্যে চারটা সংখ্যা বেরিয়েছিল। গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে বাংলাদেশের সাহিত্যে অনেক কাজ হয়েছে। সাহিত্যধারায় ঘটেছে অনেক বাঁকবদলও। এর প্রায় সবই হয়েছে ব্যক্তি সাধনা বা প্রচেষ্টায়। দলবদ্ধ, তারুণ্যদীপ্ত, অভিনব, সাহিত্যান্দোলন সেই একবার ঘটেছিল।
স্বাধীনতা উত্তরকালের নানা ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড রফিক আজাদের কাব্যমানসে ব্যাপক রেখাপাত করেছিল। শোকে মুহ্যমান হওয়াই শুধু নয়, শিল্পের নান্দনিকতায় তিনি এ মর্মন্তুদ ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর কবিতায় দেশ আছে, আছে চিরায়ত মানবিকতার কথাও। কবি রফিক আজাদের আশিতম জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় স্মরণ করছি।