বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বশেমুরবিপ্রবি ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ

প্রতিবাদরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপর এলাকাবাসীর হামলা

আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:১০

ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদ হিসেবে সড়ক অবরোধ করে স্থানীয়দের হামলার শিকার হয়েছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। 'যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে' বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হামলার নির্দেশ দেওয়া হয় মসজিদের মাইকে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টরসহ অন্তত ২০ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বিকাল সাড়ে চারটায় গোপালগঞ্জ সদরের ঘোনাপাড়ায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধকারী শিক্ষার্থীদের উপরে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় অবরোধকারী শিক্ষার্থীরা দিশেহারা হয়ে বিভিন্ন দিকে ছুটে পালান। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব, প্রক্টর ড. মো. রাজিউর রহমানসহ অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী হামলার শিকার হয়ে আশেপাশের বাড়িতে অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীদের উপরে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত দফায়-দফায় হামলা চালায় স্থানীয়রা। হামলাকারীরা প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাড়িও ভাঙচুর করে। একসময় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ক্যাম্পাসে গিয়েও দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে  শিক্ষার্থীদের উপরে হামলা চালানো হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা ও এলাকাবাসীকে উস্কানি দেওয়ার কয়েকটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওগুলো ইত্তেফাক অনলাইনের কাছে এসেছে। এক ভিডিওতে দেখা যায়, গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আতাউর রহমান পিয়াল মাইকে বলছেন, 'আমরা চলে যাচ্ছি। যারা ছাত্রলীগ করেন তারা আমাদের সাথে যাবেন, যারা করেন না তারা থাকেন, আন্দোলন চালায়ে যান। যারা জামায়াত-শিবির করেন তারা আন্দোলন চালান।'

chatroleague-ushkani

ওই বক্তব্যের পরপরই গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এম বদরুল আলম বদর বলেন, 'ও আপনাদের ওইভাবে একটু কথা বলছে, এতে আপনাদের মাইন্ড করার কিছু নাই। যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, যারা ছাত্রলীগ করেন তারা এই আন্দোলন থেকে সরে যান। তাদের অনুরোধ করি তারা আন্দোলন থেকে সরে যান। আমরা কিছু বলবো না, পরে কিছু হইলে এই যে আমাদের বোনরা আছে, এক মিনিট বলি। মা-বোনদের বলি এখানে অনেকে অনেক উদ্দেশ্য নিয়ে বসে আছে। আমরা কথা বলতে চাই না।'

ডোবা থেকে এক শিক্ষার্থীকে তুলে আনা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও থেকে ছবিটি নেওয়া হয়েছে।

এধরনের বক্তব্যের পরেই এলাকার লোকজন বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। আরেক ভিডিওতে দেখা যায়, রাস্তার পাশের নিচু জমির এক অংশের ডোবা থেকে এক শিক্ষার্থীকে টেনে তুলে আনছেন দুইজন। এলাকাবাসী ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় তাকে মারধর করে ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়।

হামলায় আহত বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারাবি, আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জাকারিয়া, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী হোসাইন, বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী দীপঙ্কর সাহা, মার্কেটিং প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিবুলকে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাজকে উন্নত চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের উপর এলাকাবাসীর হামলা। ছবি: সংগৃহীত

এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের উপরে হামলা চালিয়েছে স্থানীয়রা। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের শিক্ষার্থী হান্নান মিয়া বলেন, 'কত আয়োজন করে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে আমাদের উপর হামলা করা হলো! আমাদের বোনরা লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে, এর বিচার চাইতে গিয়েও আমরা হামলার শিকার হলাম।'

মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী মো. তাওহীদ হাসান বলেন, 'আজ কতটা আমরা অসহায় বলতে পারবো না। একঘণ্টা আগে যারা আমাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে শ্লোগান দিয়েছিল তারাই নারকীয় হামলা চালিয়েছে। পরিকল্পিত ও দলবলে প্রধান নেতাদের নেতৃত্বে মাইকে ঘোষণা করে হামলা করা হয়েছে। যাকে যেখানে পেয়েছে ইচ্ছামতো পিটিয়েছে।'

হামলায় বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. রাজিউর রহমান বলেন, এখন থেকে আর কোনো বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সাথে আলোচনা হবে না। আমরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। প্রশাসনের নজরে আনা হয়েছে প্রতিটা বিষয়। এরপরও স্থানীয়রা শিক্ষার্থীদের উপরে হামলা চালিয়েছে। এসময় প্রক্টর আরো বলেন, শুক্রবার সকাল ১১টার মধ্যে আমাদের পরবর্তী করণীয় জানানো হবে।

ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: ইত্তেফাক

প্রসঙ্গত, বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) এক ছাত্রী (২২) দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণের সাথে জড়িতদের আটকের দাবিতে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে গিয়ে বুধবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জ সদর থানা ঘেরাও করে রাখেন। পরে সকাল ৬টায় ঘোনাপাড়া গিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন। এছাড়া শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ভবন তালাবদ্ধ করে দেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষাসহ সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৬টা থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ঘোনাপাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবস্থান করে অবরোধ ঘোষণা করেন। বিকাল ৫টায় ১১ ঘণ্টার অবরোধ শেষে ধর্ষকদের শনাক্ত ও আটকের জন্য ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। এসময়ে অজ্ঞাতরা শিক্ষার্থীদের উপরে হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে বলে তারা জানান।

শিক্ষার্থীদের দীর্ঘসময় অবরোধের ফলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এসময় কয়েক হাজার গাড়ি যানজটে পড়ে। বিকাল পাঁচটায় শিক্ষার্থীদের উপরে হামলার পর অবরোধ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

ধর্ষণের প্রতিবাদে সড়কে গ্রাফিতি এঁকেছেন বশেমুরবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা। ছবি: ইত্তেফাক

ধর্ষণের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নিজে বাদী হয়ে গোপালগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেছেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে নয়টার দিকে ভুক্তভোগী ছাত্রী তার এক বন্ধুর সাথে গোপালগঞ্জ সদরের নবীনবাগ হেলিপ্যাডের সামনে থেকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এসময় ৫ থেকে ৭ জন বখাটে এসে বন্ধু সহ তাকে গোপালগঞ্জ জেলা স্কুলের নির্মাণাধীন ভবনে তুলে নিয়ে যায়। সেখানে বন্ধুকে আটকে রেখে মারধর করা হয় ও ওই ছাত্রী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। 

ভুক্তভোগী ছাত্রী তার সহপাঠীদের ঘটনা জানানোর পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।

এদিকে বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুর আড়াইটায় অবরোধকারী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলার জন্য ঘোনাপাড়া ঘটনাস্থলে যান জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা, পুলিশ সুপার আয়েশা সিদ্দিকা, গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব আলী খান, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও প্রশাসনের কর্মকতারা। তারা অভিযুক্তদের আটকের আশ্বাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের অবরোধ তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেন। এসময় জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার সাথে সহমত পোষণ করা হয়। এছাড়া দোষীদের আটক ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, কর্মচারী সমিতিসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন বিবৃতি দেয়।

গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পিয়াস সিকদার (২২), অন্তর (২১) ও জীবনকে (২০) আটক করে থানায় আনা হয়েছে। এছাড়া ঘটনাস্থলের আশপাশের ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, 'তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে অভিযান চালানো হয়েছে। আমাদের টিম অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তিনজনকে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয়েছে। আশা করছি খুব শিগগিরই জড়িত সকলকে আটক করা হবে।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. রাজিউর রহমান সেসময় সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলেছি এবং আমি নিজে এ ঘটনায় বাদী হয়ে গোপালগঞ্জ সদর থানায় মামলা দায়ের করেছি।' সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব বলেন, 'যে ঘটনা ঘটেছে তা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ও ঘৃণ্য। জড়িতদের দ্রুত আটকের জন্য প্রশাসনের সাথে আমরা বারবার কথা বলে যাচ্ছি।'

ইত্তেফাক/এসটিএম