শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৭ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বশেমুরবিপ্রবি ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ

নিরাপত্তাহীনতায় ছাত্রীরা, চার দফা দাবিতে আন্দোলন চলছে

আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:৪১

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রী অভিযোগ করে বলেন, ‘গত দুইদিন ধরে আমরা বাইরে বের হওয়া দূরে থাক, বাসার বারান্দাতেও যেতে পারছি না। সবসময় বাসার চারপাশে স্থানীয় বখাটেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের উদ্দেশ্য করে অশোভন আচরণ করছে। এমনকি এলাকার মহিলারাও আমাদের নিয়ে বিভিন্ন বাজে মন্তব্য করছে। তাদের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মানেই চরিত্রহীন। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পেছনে যেন আমাদেরই দায়।’

ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তৃতীয় দিনে গড়িয়েছে। চার দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ধর্ষকদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে ফাঁসি দেওয়া, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে হামলাকারীদের শনাক্ত ও আটক, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে সকল স্থানে বসবাস করেন সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। এর আগে সকাল ৭টায় আন্দোলনকারী  শিক্ষার্থীরা জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন।


বিচারের দাবিতে মোমবাতি প্রজ্বলন
সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্বলন করেছেন বশেমুরবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা। ছবি: ইত্তেফাক

এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে মোমবাতি প্রজ্বলন কর্মসূচি পালন করেছেন বশেমুরবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা। শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে এ কর্মসূচি শুরু হয়। পরে শিক্ষার্থীরা জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘ওইদিন আমরা সড়ক অবরোধ করার পর স্থানীয় প্রশাসন এসে আমাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে অবরোধ তুলে নিতে বলেন। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ চলে যাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। তাই গোপালগঞ্জের স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি আমরা এখন আর বিশ্বাস রাখতে পারছি না। এখন আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ আশা করছি এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার প্রত্যাশা করছি।’


প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধন
গত বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে হামলায় প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় প্রতিবাদ জানিয়ে শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১২টায় চোখে কালো কাপড় বেঁধে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বিকাল ৪টায় 'ভিক্টিম-ব্লেমিংয়ের' প্রতিবাদে এবং ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে ছাত্রীরা প্রতিবাদ মিছিল বের করেন।

চোখে কালো কাপড় বেঁধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ। ছবি: ইত্তেফাক
অন্যদিকে শিক্ষার্থীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টায় শিক্ষক সমিতির ব্যানারে মানববন্ধন করেছেন পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী। মানববন্ধনে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘বশেমুরবিপ্রবিতে যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে সেটি কখনোই কাম্য নয়। এই ঘটনার বিচার চাইতে গিয়ে যদি আমাদের মার খেতে হয় তাহলে সেটি আরও ন্যাক্কারজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এই সকল ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টন্তমূলক শাস্তি চায়। দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত না করলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরো ঘটবে।’

শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি। ছবি: ইত্তেফাক


নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ছাত্রীরা
ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর থেকে ক্যাম্পাসের বাইরে বিভিন্ন মেসে থাকা কয়েক হাজার ছাত্রী একপ্রকার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানা গেছে। দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পরে গোবরাসহ কয়েকটি এলাকার বিভিন্ন মেসে থাকা ছাত্রীরা অনেকটা ঘরবন্দি জীবনযাপন করছেন। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের দেখে বখাটেসহ স্থানীয় মহিলারাও অশোভন আচরণ করছেন বলে অর্ধশতাধিক ছাত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রী অভিযোগ করে বলেন, ‘গত দুইদিন ধরে আমরা বাইরে বের হওয়া দূরে থাক, বাসার বারান্দাতেও যেতে পারছি না। সবসময় বাসার চারপাশে স্থানীয় বখাটেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের উদ্দেশ্য করে অশোভন আচরণ করছে। এমনকি এলাকার মহিলারাও আমাদের নিয়ে বিভিন্ন বাজে মন্তব্য করছে। তাদের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মানেই চরিত্রহীন। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পেছনে যেন আমাদেরই দায়।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. রাজিউর রহমান জানিয়েছেন, ‘যেহেতু আমাদের হলগুলোতে পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা নেই, তাই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অবস্থিত ছাত্রীদের কাছ থেকে এমন অভিযোগ পাওয়ার পরে বাড়ির মালিকদের সাথে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।’

চলমান আন্দোলন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব বলেন, ‘গত কয়েকদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে যে সকল অন্যায় হয়েছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে রাস্তায় দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেন এই ধরনের কাজ করার সাহস যেন দুস্কৃতিকারীরা না পায় এজন্য তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি। আর শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সতর্কভাবে চলাফেরার অনুরোধ জানাচ্ছি।’


ধর্ষণে অভিযুক্ত ৬ জন গ্রেফতার
এদিকে শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) গোপালগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে ধর্ষণে অভিযুক্ত ৬ জনকে আটক করেছে র‍্যাব। এ বিষয়ে শনিবার দুপুরে রাজধানীতে র‌্যাবের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। আটকৃতরা হলো- রাকিব মিয়া ওরফে ইমন (২২), পিয়াস ফকির (২৬), প্রদীপ বিশ্বাস (২৪), মো. নাহিদ রায়হান (২৪), মো. হেলাল (২৪) এবং তূর্য মোহন্ত (২৬)। এর আগে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পিয়াস সিকদার (২২), অন্তর (২১) ও জীবন (২০) নামে তিনজনকে আটক করেছিল।


নবীনবাগে দিনে-দুপুরে অস্ত্রের মহড়া
রাজধানীতে র‌্যাবের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের পরে গোপালগঞ্জ সদরের নবীনবাগে কয়েকজন যুববকে অস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে। এতে ভয় পেয়ে ওই এলাকায় বসবাসরত শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যদের সাহায্য চান। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে এ বিষয়টিকে 'ভুল বোঝাবুঝি' উল্লেখ করে স্থানীয় কাউন্সিলর আল-আমিন বলেন, ‘আমার বাড়িতে হামলা হতে পারে এমন একটা গুজবের কারণে লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে বের হয়েছিল। এতে শিক্ষার্থীদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’

এ বিষয়ে গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা খবর পেয়ে নবীনবাগে গিয়েছিলাম। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।’

প্রসঙ্গত, বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) এক ছাত্রী (২২) দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. রাজিউর রহমান বাদী হয়ে গোপালগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেন। ধর্ষণের সাথে জড়িতদের আটকের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাতে গোপালগঞ্জ সদর থানা ঘেরাও করেন এবং দিনভর ঘোনাপাড়ায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। এসময় স্থানীয়রা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রতিবাদরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপরে হামলা চালিয়ে উপাচার্য, প্রক্টরসহ কমপক্ষে ২০ জনকে আহত করে। এরপরই আন্দোলনে ফুঁসে ওঠেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। এতে সংহতি জানিয়ে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মানববন্ধন ও মশাল মিছিল করেছেন।

ইত্তেফাক/এসটিএম