মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সুপেয় পানির সংকটে রাজধানী

আপডেট : ১৭ মে ২০১৯, ২২:৪৪

যেসব পানি আমরা প্রতিদিন খাচ্ছি তা কি সুপেয়? বাসায় পানি ফুটিয়ে বা ফিল্টার করা পানি হয়তো কিছুটা সুপেয়। কিন্তু হোটেলে, রাস্তা-ঘাটে ফিল্টার করা পানির নামে নীল জারের যেসব পানি আমরা হরহামেশা পান করি তা কতটুকু সুপেয়? যেসব হোটেলে আমরা খাবার খাই সেসব হোটেল কি ফিল্টার প্ল্যান্ট বসিয়েছে? নাকি সাপ্লাইয়ের পানি খাওয়াচ্ছে আমাদের! আমার সবাই জানি, এই সাপ্লাই পানি দূষিত। এসবের নজরদারি কি ঠিকমতো হয়? খুব সহজেই বলা যায়, নজরদারি ঠিকমতো হয় না। তা ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান দেশজুড়ে ফিল্টার পানি সরবরাহ করছে এদের মধ্যে খুব অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানই বিএসটিআইয়ের অনুমোদন পাওয়া। অধিকাংশই অবৈধ। দূষিত পানি পান করার ফলে সম্প্রতি ভয়াবহ হারে বেড়ে গেছে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ।

ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করে তা যেমন সুপেয় নয়, আবার ওয়াসা ভূ-গর্ভ থেকে যে পানি উত্তোলন করছে সেটাও রাজধানীর জন্য মারাত্মক হুমকি। বর্তমানে প্রতিদিনের চাহিদার ৭৮ শতাংশ পানি আসে ভূ-গর্ভ থেকে। আর ২২ শতাংশ পানি আসে ভূ-উপরিস্থ উত্স থেকে।

ওয়াটার এইড বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতিবছর পানির স্তর নামছে তিন মিটার হারে। আর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত এক দশকে রাজধানী ঢাকায় আড়াই মিটার হারে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, এই অবস্থা যদি আরো কয়েক দশক চলতে থাকে তবে দেখা দেবে পানির নিদারুণ অভাব, সেইসঙ্গে ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসবে।

ঢাকায় বাড়ছে অগণিত অট্টালিকা, প্রতিদিন বাড়ছে অসংখ্য মানুষ। সেইসঙ্গে বাড়ছে বছরে ১০ শতাংশ হারে পানির চাহিদা। আর পানির এ বর্ধিত চাহিদা মেটাতে পারছে না ঢাকা ওয়াসা। বর্তমানে রাজধানীতে দৈনিক পানির চাহিদা ৩০০ কোটি লিটারের বেশি। আর ঢাকা ওয়াসা গড়ে পানি উত্পাদন করেছে ২৫০ কোটি লিটার। এর মধ্যে সিস্টেম লস হচ্ছে ২২ শতাংশ। চাহিদার বিপরীতে কম পানি উত্পাদন ও সরবরাহ এবং সেইসঙ্গে পানির বড় ধরনের সিস্টেম লসের কারণে রাজধানীর পানি সংকট থেকে যাচ্ছে। এ সংকটকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিবছর পানির ১০ শতাংশ বর্ধিত চাহিদা।

বর্তমানে ঢাকা মহানগরী ও নারায়ণগঞ্জ শহর ঢাকা ওয়াসার সেবা এলাকা হিসেবে পরিচিত। ঢাকা ওয়াসার সমগ্র সেবা এলাকা ১১টি ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভক্ত। এর মধ্যে ১০টি অঞ্চল ঢাকা মহানগরী নিয়ে এবং ১টি অঞ্চল নারায়ণগঞ্জ নিয়ে গঠিত।

রাজধানীতে সুপেয় পানি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ওয়াসা জানাচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য সুপেয় ও নিরাপদ পানি সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ঢাকা ওয়াসা। এ জন্য ওয়াসা ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে তিনটি বৃহত্ প্রকল্প রয়েছে। মহানগরীর একজন মানুষও যেন নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করা হবে। সায়েদাবাদ ফেজ-৩, পদ্মা জশলদিয়া ও গান্ধবপুর পানি শোধনাগার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে গান্ধবপুর বাদে বাকি দুটি প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। বৃহত্ তিনটি প্রকল্প থেকে ঢাকা শহরে পানি সরবরাহ শুরু হলে মানুষ শতভাগ সুপেয় পানি পাবেন। তখন নগরবাসী সরাসরি কলের পানি পান করতে পারবেন। পানি আর কাউকে ফুটিয়ে খেতে হবে না। ইতোমধ্যে গোটা ঢাকা শহরে পানির নতুন পাইপ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকার অনেক এলাকায় প্লাস্টিকের নতুন পাইপ বসানো হয়েছে। বাকি এলাকাতে এ বছরের মধ্যে পাইপ স্থাপনের কাজ শেষ হবে।

এ প্রসঙ্গে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান জানান, ২০২১ সাল নাগাদ ঢাকা শহরে সরবরাহকৃত পানির ৭০ ভাগ আসবে ভূ-উপরিস্থ পানির উত্স থেকে। অবশিষ্ট ৩০ ভাগ ভূ-গর্ভস্থ তথা গভীর নলকূপ থেকে আসবে। ঢাকা দ্রুত সম্প্রসারণ ও লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পানির চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানির চাহিদা পূরণে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা কর্মসূচি’র আওতায় পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও গণমুখী পানি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করেছে ঢাকা ওয়াসা।

ওয়াসার পানি দূষিত

নগরবাসীর দীর্ঘদিনের অভিযোগ, ওয়াসার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে ফোটানো হলেও কিছু এলাকায় সরবরাহকৃত পানি থেকে দুর্গন্ধ যাচ্ছে না, তা পানযোগ্যও করা যাচ্ছে না।

খোদ ওয়াসার প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এ তথ্য। ঢাকা মেট্রোপলিটন এরিয়ার দশটি জোনের ৫৯টি এলাকায় ওয়াসার ময়লা পানি বেশি পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াসার ময়লা পানি বেশি পাওয়া যায় সেসব এলাকা হচ্ছে: মডস জোন-১: যাত্রাবাড়ী, বাসাবো, মুগদা, রাজারবাগ, কুসুমবাগ, জুরাইন, মানিকনগর, মাণ্ডা, দোলাইরপাড় ও মাতুয়াইল। মডস জোন-২: ভাগলপুর, লালবাগ, বকশিবাজার এবং শহীদনগর। মডস জোন-৩: জিগাতলা, ধানমন্ডি, শুক্রাবাদ, কলাবাগান, ভূতেরগলি এবং মোহাম্মদপুর। মডস জোন-৪: শেওড়াপাড়া, পীরেরবাগ, মনিপুর, পাইকপাড়া এবং মিরপুর। মডস জোন-৫: মহাখালী এবং তেজগাঁও। মডস জোন-৬: সিদ্ধেশ্বরী, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, মগবাজার, নয়াটোলা, রামপুরা, মালিবাগ এবং পরীবাগ। মডস জোন-৭: কদমতলী, ধনিয়া, শ্যামপুর, রসুলবাগ, মেরাজনগর, পাটেরবাগ, শনিরআখড়া, কোনাপাড়া এবং মুসলিম নগর। মডস জোন-৮: বাড্ডা, আফতাবনগর, বসুন্ধরা এবং ভাটারা। মডস জোন-৯: উত্তরা, খিলক্ষেত, ফায়েদাবাদ, মোল্লারটেক এবং রানাভোলা। মডস জোন-১০: কাফরুল, কাজীপাড়া, মিরপুর, কচুক্ষেত এবং পল্লবী।

ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান জানান, ঢাকা শহরের যেসব এলাকায় ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়া (ডিএমএ) ভিত্তিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে সেসব এলাকায় ময়লা পানির অভিযোগ খুবই কম। তবে অন্য কোনো সংস্থা/কোম্পানি যখন কাজ করে তখন ডিএমএর পানির পাইপ লাইন ছিদ্র করা হলে ময়লা পানির অভিযোগ পাওয়া যায়। ওই অভিযোগ পেলে লাইন মেরামত করে ময়লা পানির সমস্যা দূর করা হয়। ডিএমএর বাইরের এলাকায় বহু বছরের পুরাতন ও জরাজীর্ণ পাইপ রয়েছে। সে সকল এলাকায় ময়লা পানির অভিযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি পাওয়া যায়। তবে অভিযোগ পাওয়ার পর পাইপ লাইনের লিকেজ মেরামত করে ময়লা পানির অভিযোগ নিরসন করা হয়।

ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, ১৯৬৩ সালে ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যুয়ারেজ অথরিটি বা ওয়াসা নামে এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটি সত্তর দশক পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে পানি সরবরাহ করে এসেছে। আশির দশকের শুরুতে ঢাকায় জনসংখ্যা বাড়ার পর থেকে পানি সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ওয়াসা একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। কিন্তু সুপেয় পানি সরবরাহ আর নিশ্চিত করতে পারেনি।

ওয়াসার প্রকল্পসমূহ

বর্তমানে ঢাকা মহানগরী ও নারায়ণগঞ্জে ওয়াসার কমপক্ষে ছয়টি প্রকল্প চলমান থাকলেও নিশ্চিত হয়নি সুপেয় পানির সরবরাহ। বিদেশি ঋণে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে। চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে— ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, নারায়ণগঞ্জ শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সমপ্রসারণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প, সাভারের তেঁতুলঝোরা-ভাকুর্তা এলাকায় ওয়েলফিল্ড নির্মাণ (১ম পর্ব) প্রকল্প, পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগর প্রকল্প, ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট ও সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেজ-৩।

ঢাকায় পানি সরবরাহের পুরনো পাইপ লাইন পুনর্বাসনের জন্য এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সমপ্রসারণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের জন্য ৮১ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। মিরপুর এলাকার পানি সরবরাহ করার জন্য ‘সাভারের তেঁতুলঝোরা-ভাকুর্তা এলাকায় ওয়েলফিল্ড নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার আর্থিক সহায়তায় প্রকল্পটিতে ব্যয় হবে ৫২১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্প’ ৩ হাজার ৩৭৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে শুরু হয়েছে।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকায় দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ হবে। মেঘনা নদীর পানি ঢাকায় নিয়ে আসতে ওয়াসার রয়েছে ‘ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট। এই প্রকল্পে ৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। প্রকল্পটি এ বছরের ডিসেম্বরে শেষ হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে মেঘনা নদীর পানি শোধন করে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি ঢাকা মহানগরীতে সরবরাহ করা হবে। সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেজ-৩ কাজ চলছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মেঘনা নদী থেকে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হবে। প্রকল্পটি ২০২১ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।

ওয়াসার সৃষ্টি

১৮৪৭ সালে নবাব খাজা আব্দুল গণি নির্মিত চাঁদনীঘাট পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্টের মাধ্যমে ঢাকা শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ শুরু হয়। ঊনিশ শতকের পঞ্চাশ-এর দশকে আরো বড় আকারে ঢাকা নগরীতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা শুরু হয়। ১৯২৩ সালে ঢাকা মহানগরীতে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা চালু হয়। ঢাকা শহরের ড্রেনেজ কার্যক্রম ১৯৪৬ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সরকার পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের পুনর্ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শহর ও গ্রাম অঞ্চলে এই সেবা দিতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সৃষ্টি করে। ১৯৬৩ সালে ঢাকা শহরের পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য একটি আলাদা সংস্থা হিসেবে ঢাকা ওয়াসা সৃষ্টি করা হয়। পরে ঢাকা মহানগরীর পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্ব জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ঢাকা ওয়াসাকে দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালের জুন পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসার সেবা এলাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার মধ্যেই সীমিত ছিল। ১৯৯০-এর প্রথমদিকে নারায়ণগঞ্জ শহর এলাকার পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্বও ঢাকা ওয়াসা গ্রহণ করে। ১৯৮৯ সালে সরকারি আদেশে রাজধানীর ড্রেনেজ কার্যক্রম ঢাকা ওয়াসার উপর ন্যস্ত হয়।