শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ

দৃষ্টিনন্দন সড়কে ‘দৃষ্টিকটূ পুলিশ বক্স’ কেন

আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২২, ২২:১৬

ঢাকা শহরের অন্যতম নান্দনিক ও প্রশস্ত সড়ক মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে প্রবেশের কয়েকটি পথ রয়েছে। একটি ফার্মগেট থেকে খামারবাড়ি অথবা ইন্দিরা রোড হয়ে, অন্যটি মিরপুর রোড থেকে। এছাড়া, উত্তর দিক থেকে সংসদ ভবন অ্যাভিনিউতে এসে খামারবাড়ি গোলচত্বরের মাধ্যমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে সংযুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি এই সড়কটির পূর্বদিকের প্রবেশ মুখে রাস্তার মাঝ বরাবর তৈরি করা হয়েছে  ট্রাফিক পুলিশ বক্স। দৃষ্টিনন্দন সড়কটির সঙ্গে এই স্থাপনাটি একেবারেই বেমানান বলে মন্তব্য করেছেন নগরপরিকল্পনাবিদসহ সচেতন ব্যক্তিরা। 

বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে থাকা দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নামে এই সড়কটি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম ক্যাবিনেটে সংসদ ভবনের সামনের সড়কটিকে 'মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ' হিসেবে নামকরণ করেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ঢাকায় এলে সংসদ ভবন দেখতে এই সড়কটি দিয়েই যাতায়াত করেন। দীর্ঘ পরিক্রমায় এটি একটি ঐতিহ্যবাহী সড়কে রূপ নিয়েছে।

২০১৯ সালে বৃহত্তম এশিয়ার স্থপতিদের সংগঠন আর্ক এশিয়ার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে, যে আয়োজনকে উপলক্ষ করে বর্ণিল সাজে সেজেছিল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। কন্টেইনারের গায়ে আঁকা ছবি ও গ্রাফিতি দিয়ে 'আর্কিটেকচার অব বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রদর্শনী চলে এই সড়কে।

পাখির চোখে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। ছবি: আব্দুল গনি

সরেজমিনে দেখা গেছে, খামারবাড়ি গোলচত্বরের সন্নিকটে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে প্রবেশ-প্রান্তে রোড ডিভাইডারের আইল্যান্ডের ওপর একটি ট্রাফিক পুলিশ বক্স নির্মাণ কাজ চলছে। স্থাপনাটির মূল কাঠামোর কাজ শেষ, এখন জানালার কাঁচ বসানো হবে। গৎবাঁধা আকৃতির এই স্থাপনার যে প্রান্তটি সরাসরি চোখে পড়ে, সেদিকে একটি টয়লেটের জানালা রয়েছে। এছাড়া, ছাদের ওপর একটি প্লাস্টিকের পানির ট্যাংক দৃশ্যমান। সড়কের নান্দনিকতা বিবেচনায় এই স্থাপনার বাহ্যিক রূপ এখানে দৃষ্টিকটূ বলে মনে করছেন পথচারীরা। একই কথা বলেছেন স্থপতি-পরিকল্পনাবিদরাও। 

শিক্ষার্থী শাফিন তালুকদার প্রায়ই বন্ধুদের সঙ্গে এই সড়ক দিয়ে আসাযাওয়া করেন। তিনি বললেন, 'হঠাৎ রাস্তার মধ্যবর্তী একটি স্থানে এই স্থাপনাটি খুবই দৃষ্টিকটূ বলে মনে হয়েছে। সংসদ ভবনের দিকে যাওয়ার পথের প্রবেশমুখ হিসেবে এই সড়ককে বিবেচনা করলে এখানে আকর্ষণীয় একটি স্থাপনা হলে ভালো মানাতো।'

আরেক পথচারী ফাহমিদুর রহমান বলেন, 'ঢাকা শহরে এখন অনেক সুন্দর সুন্দর ভবন তৈরি হচ্ছে। সেসব দেখে মনে হয় আমরা অনেক এগিয়ে যাচ্ছি। তবে হয়তো সবক্ষেত্রে আমাদের রুচির প্রয়োগ সমানভাবে ঘটছে না। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের স্যানিটেশন ও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য শহরের সবজায়গায় বক্স স্থাপন জরুরি, কিন্তু সেগুলো ভিন্নভাবে হতে পারে।'

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের পূর্বদিকে সড়ক বিভাজকের মাঝে এই পুলিশ বক্সটি স্থাপন করা হয়েছে। ছবি: আব্দুল গনি

যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ডিজাইন বিভাগের শিক্ষক স্থপতি তানজীল শফিক বলেন, 'ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালনকালে তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, টয়লেট, বিশ্রামের জায়গা থাকা প্রয়োজন, এটি অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু স্থায়ী স্থাপনা হলে নান্দনিকতার বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু এটি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে স্থাপন করা হয়েছে, তাই চারপাশের সঙ্গে মিল রেখে এটি একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা হতে পারতো। সরকারি কোনো স্থাপনা তৈরি হলে সেটি গৎবাঁধাভাবে তৈরির যে অভ্যাস বা রুচি গড়ে উঠেছে, এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শহর বা নগরের এমন ছোট কাজগুলোতে স্থাপত্যের শিক্ষার্থীদেরও সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তারা ডিজাইন কম্পিটিশনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন নকশা উপস্থাপন করবে, এতে নান্দনিক ও ব্যতিক্রমী কিছু ভাবনা উঠে আসবে।'
 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ পরিকল্পনা ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি ড. আকতার মাহমুদ বলেন, 'অনেক জায়গায় দেখি ট্রাফিক পুলিশ বক্স ফুটপাতের পাশে তৈরি করা হয়, বা রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে তৈরি করা হয়। এর ফলে পথচারীরা চলাচল করার সময় ফুটপাত থেকে নেমে ওইটুকু অংশ পার হন। আমরা ইনক্লুসিভ প্ল্যানিং বা জনসম্পৃক্ত পরিকল্পনা নিয়ে যে আলোচনা করি, এতে তার ব্যত্যয় ঘটে। একইভাবে, রাস্তার মাঝে রিফিউজি আইল্যান্ডে (পথচারীরা পারাপার হওয়ার সময় মধ্যবর্তী যে স্থানে দাঁড়ান) ট্রাফিক পুলিশ কোনো স্থাপনা তৈরি করলে দেখতে হবে সেটি কতটা মানানসই। যথাযথ পরিকল্পনা না হলে সেটি দুর্ঘটনা বা যানজট বাড়িয়ে দেবে। নান্দনিকতার বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।'
 

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের পুলিশ বক্সটি সম্পর্কে আকতার মাহমুদ বলেন, 'সড়কের মধ্যবর্তী কোনো স্থানে এভাবে স্থায়ী স্থাপনা না বসিয়ে রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ডিএমপি সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। জনসাধারণের নিরাপত্তায় ও পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ট্রাফিক পুলিশের জন্য জায়গা প্রয়োজন হবেই। শহরের যে সব স্থানে এ রকম ট্রাফিক বক্স দরকার সেখানকার প্লট মালিকদের সাথে সমঝোতা করা যেতে পারে। ট্রাফিক বক্সের জন্য জায়গার বিনিময়ে দেড়গুণ বা দ্বিগুণ ফ্লোর স্পেস অতিরিক্ত নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হলে, প্লট মালিক এরকম বক্স তার প্লটেই নির্মাণের সুযোগ দেবে।'

এই পুলিশ বক্সের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-তেজগাঁও) কাজী মিজানুর রহমান বলেন, 'এখানে একজন ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করবেন। যানবাহন মনিটরিংয়ের বিষয়টিও সহজ হবে। পুলিশ বক্সে স্যানিটেশনের ব্যবস্থা থাকবে, যেটি ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের জন্য একান্তই প্রয়োজন। তারা রোদবৃষ্টি উপেক্ষা করে সারাদিন দায়িত্ব পালন করেন, অথচ অধিকাংশ জায়গায় মানসম্মত টয়লেট-সুবিধা নেই। নতুন বক্সটি এক্ষেত্রে সহায়ক হবে।'

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে সড়ক বিভাজকে স্থাপন করা পুলিশ বক্স। দৃষ্টিনন্দন সড়কটির সঙ্গে এই স্থাপনা একেবারেই বেমানান বলে মন্তব্য করেছেন নগরপরিকল্পনাবিদসহ সচেতন ব্যক্তিরা। ছবি: আব্দুল গনি

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, 'জনস্বার্থে ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার স্বার্থে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে পুলিশ বক্স স্থাপন করতে হয়। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে পুলিশ বক্স স্থাপনের স্থান নির্ধারণ ও পরিকল্পনা করা হয়। তবে এটাও সত্যি যে, জরুরিভিত্তিতে এ ধরনের স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে অনেকসময়ই নান্দনিকতার বিষয়টি উহ্য থেকে যায়। আমরা চাই না আমাদের কোনো নির্মাণকাজের কারণে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটুক, তাই ট্রাফিক পুলিশ বক্স তৈরির কাজগুলো যথাসম্ভব দ্রুত সম্পন্ন করার চেষ্টা থাকে। আবার নকশা প্রণয়ন ও পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করলেও আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'তবে যে স্থাপনাটির কথা বললেন, সেটি চাইলেই পরিবর্তন-পরিমার্জন করা সম্ভব। নান্দনিকতার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে চেষ্টা থাকবে।'

ইত্তেফাক/এসটিএম/এনই