শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

হঠাৎ বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ

আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২২, ০৮:০০

দেশে হঠাৎ করেই ভয়াবহ আকারে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। এক মাস আগেও যেখানে আইসিডিডিআরবিতে (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ) প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ রোগী ভর্তি হতো, এখন প্রতিদিন সেখানে ভর্তি হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ জনেরও বেশি। অর্থাৎ দ্রুত গতিতে দুই থেকে আড়াই গুণ রোগী বেড়েছে।

পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, হাসপাতালের বিছানায় রোগীদের এখন ঠাঁই দেওয়া যাচ্ছে না। আইসিডিডিআরবিতে দুটি তাঁবু টানিয়ে রোগীদের চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে। তাতেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় গতকাল শুক্রবার আরেকটি তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়।

চিকিৎসকরা বলছেন, এভাবে রোগী আসতে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

আইসিডিডিআরবি হাসপাতাল শাখার প্রধান ডা. বাহারুল আলম ইত্তেফাককে বলেন, ‘দুই মৌসুমে বাংলাদেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে। একটা গরমের শুরুতে, আরেকটা শীতের শুরুতে। এখন গরমের মৌসুম শুরু হচ্ছে ফলে ডায়রিয়ার রোগী কিছুটা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গত কয়েক দিনে এই বৃদ্ধির হারটা অস্বাভাবিক রকম বেশি।

ছবি: ইত্তেফাক

তিনি বলেন, সবার মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে, সেটা হলো ডায়রিয়া হলেই আইসিডিডিআরবিতে রোগীকে নিয়ে আসতে হবে। ফলে আমাদের এখানে চাপ এতটাই বেশি যে, স্বাভাবিক চিকিত্সা কার্যক্রম চালু রাখতে পারছি না। সরকারি যে কোনো হাসপাতালে গেলেই ডায়রিয়া রোগের চিকিত্সা পাওয়া যায়। সব জায়গাতেই একই ধরনের চিকিত্সা।’

গরমের মৌসুম শুরু হলে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে, এটা তো আগে থেকেই জানা, তাহলে কেন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বেনজীর আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, ‘এর জন্য একটা সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, তখন স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও ওয়াসাকে সঙ্গে নিয়ে কিছু যৌথ উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সেগুলোর আর বাস্তবায়ন হয়নি। মূলত আইসিডিডিআরবি এই উদ্যোগগুলো নিতে পারে। তাদের মূল কাজ ডায়রিয়া নিয়ে গবেষণা করা। কিন্তু তারা এখন এই কাজের বাইরে আরো অনেক রোগ নিয়ে গবেষণা করছে। ফলে মূল কাজ থেকে ফোকাস হারিয়ে যাচ্ছে। এখন এদিকে তাদের মনোযোগ দরকার।’

আইসিডিডিআরবির হিসাবে গত এক সপ্তাহে সেখানে ভর্তি হয়েছে সাড়ে ৮ হাজারেরও বেশি রোগী। গত শুক্রবার ১ হাজার ১৩৮, শনিবার ১ হাজার ২৪৫, রবিবার ১ হাজার ২৩০, সোমবার ১ হাজার ৩৩৪, মঙ্গলবার ১ হাজার ৩১৭ জন, বুধবার ১ হাজার ৩৩১ জন এবং বৃহস্পতিবার ১ হাজার ৩২৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন এই হাসপাতালে। আর বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে শুক্রবার বেলা ১২টা পর্যন্ত ১ হাজারেরও বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে। ফলে শুক্রবারের হিসাবটা আগের যে কোনো দিনের তুলনায় বেশি হবে। সাত দিনে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৮ হাজার ৯২২ জন। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ১ হাজার ২৭৫ জন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, ‘মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর মানুষের অসাবধানতা, বাইরের খাবার ও পানীয় গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। এমন অসতর্কতার কারণে এবার ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকার নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় থেকে রোগী বেশি আসে।

ঢাকার যাত্রাবাড়ী, মুগদা, শনিরআখড়া, মানিকনগর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, কড়াইল, মোহাম্মদপুর, মিরপুরে ডায়রিয়ার প্রকোপটা বেশি। ঐসব এলাকায় এখন খাবার পানির তীব্র সংকট। ফলে ঐ এলাকার বাসিন্দারা যে পানি পান করছেন সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দূষিত। এখন ওয়াসাকে দ্রুত ঐসব এলাকায় খাবার পানির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’

ছবি: ইত্তেফাক

তিন দিন আগে পেটব্যথা আর পাতলা পায়খানা শুরু হলে মিরপুরের ভাসানচরের সাকিলা পারভীনকে আইসিডিডিআরবিতে নেওয়া হয়। মূল হাসপাতালে জায়গা না হওয়ায় তাকে তাঁবুতে থাকতে দেওয়া হয়েছে।

গৃহবধূ সাকিলার স্বামী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বাসার কল দিয়ে যে পানি আসছে তাতে কয়েক দিন ধরেই দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। পানি ফুটানোর পরও এই দুর্গন্ধ যায় না। এর মধ্যে আবার ঐদিন বিকালে ঘুরতে বেরিয়ে ফুচকা খেয়েছে। রাতেই তার পেটব্যথা শুরু হয়। সকাল থেকে পাতলা পায়খানা আর বমি হতে থাকে। এক দিন বাসায় রেখে চেষ্টা করেছি। কিন্তু পায়খানা বন্ধ না হওয়ায় আমরা তাকে আইসিডিডিআরবিতে নিয়ে আসি।’

শুধু কি খাবার পানির কারণেই এমনটা হচ্ছে? জানতে চাইলে ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ইত্তেফাককে বলেন, ‘এটা তো প্রধান কারণ। কিন্তু এর বাইরেও অনেকগুলো কারণ আছে। গত দুই বছর করোনার কারণে আমরা অত্যন্ত সতর্ক ছিলাম। ফলে সবাই মাস্ক পরে চলেছি, কিছুক্ষণ পরপর সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছি। ফলে জীবাণু আর পেটে যেতে পারিনি। এখন বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর এসব কিছু আর মানছি না। বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানি খাচ্ছি ব্যাপক হারে। বাচ্চারা স্কুলের সামনে থেকে যা পাচ্ছে সেগুলো খাচ্ছে। এতে ডায়রিয়া ছড়াচ্ছে বেশি মাত্রায়।’

তিনি বলেন, বায়ুদূষণের কারণেও ডায়রিয়া হতে পারে। ঢাকায় রাস্তায় এখন যে পরিমাণ ধুলা তাতে বায়ুদূষণ বেড়ে গেছে। আমার পরামর্শ হলো, বাইরের খাবার কিংবা পানি না খেয়ে কোথাও গেলে খাবার এবং পানি বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া ভালো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া দরকার। মাস্ক পরার অভ্যাসটা ধরে রাখতে পারলে খুবই ভালো।’

ডা. বাহারুল আলম বলেন, ‘আমাদের অনেক জায়গায় ড্রেনের মধ্য দিয়ে পানির লাইন গেছে। যেখানে পানির সমস্যা আছে, সেখানে অনেকেই পানির লাইন ছিদ্র করে চোরাই লাইন নেয়। ফলে দেখা যাচ্ছে, ঐছিদ্র দিয়ে ডায়রিয়ার জীবাণু পানির লাইনে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে ঐ এলাকার মানুষের মধ্যে এটা ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের তো পানি দরকার। যে কোনোভাবে সে এটা পেতে চাইবে। ফলে ওয়াসা যদি সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে তাহলে চোরাই লাইনের প্রবণতা কমবে। এতে এই ধরনের পরিস্হিতি এড়ানো সম্ভব বলে আমি মনে করি।’