শনিবার, ০৩ জুন ২০২৩, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

৪৫ বছর পর মায়ের বুকে ফিরলেন কুলসুম

আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২২, ২৩:০৭

কিছু বাস্তব জীবন গল্প যেন হার মানায় সিনেমার চিত্রনাট্যকেও। তেমনই এক বিস্ময়কর ঘটনার জন্ম দিয়েছেন ম্যারিও কুলসুম।  ৪৫ বছর আগে পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে পাঁচ বছর বয়সে কুলসুমের ঠাঁই মেলে সুইজারল্যান্ডের এক অনাথ আশ্রমে। এরপর তাকে দত্তক নেন এক সুইস দম্পতি। ৪৫ বছর পর কুলসুম দেশে ফিরেছেন শেকড়ের টানে। আবছা স্মৃতিতে খুঁজে বেড়িয়েছেন হারিয়ে যাওয়া আপনজনদের। দীর্ঘ অপেক্ষার হাহাকার শেষে সোশ্যাল মিডিয়ায়ভিত্তিক অনুষ্ঠান সাইবার লাইফের উপস্থাপক মুনজুরুল করিম ও কুলসুম-আন্দ্রে দম্পতির সম্মিলিত প্রচেষ্টার পর কুলসুম ফিরে পেয়েছেন নিজের পরিবারকে। ৪৫ বছর পর মা বলে ডেকেছেন মেয়ে।

পরিবারের সঙ্গে ভিডিওকলে কথা বলছেন কুলসুম। ছবি: সংগৃহীত

অভাবে তাড়নায় দুই মেয়ে নিয়ে ঢাকায় আগমন:
সময় ১৯৭৭ সাল। আগুনে পুড়েছে ঘর; স্বামী মৃত। পাঁচ সন্তান নিয়ে টানাপড়েনের সংসার চালাচ্ছেন মাফিয়া বেগম। এমন অবস্থায় দুই মেয়ে কুলসুম ও শামুকে নিয়ে বরিশাল থেকে ঢাকার মোহাম্মদপুরে দেবরের বাসায় আসেন। উদ্দেশ্য মেয়েদের অনাথ আশ্রমে দেবেন। যথারীতি মোহাম্মদপুরে একটি অনাথ আশ্রমে তাদের দিয়েও আসেন। কিন্তু দুই দিন বাদে সেখান থেকে পালিয়ে মায়ের কাছে চলে আসে বড় মেয়ে কুলসুম। আশ্রমে দায়িত্বে থাকা দুই জন নারী কর্মকর্তা সেদিন মায়ের কাছ থেকে টেনেহিচঁড়ে নিয়ে যান কুলসুমকে। এটিই তার শেষ যাওয়া, যে যাওয়া তাকে ৪৫ বছর ধরে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল মায়ের আঁচল থেকে।

 

অনাথ আশ্রম থেকে সুইস দম্পতির কাছে দত্তক
সুইজারল্যান্ডের টিডিএইচ ঢাকা অফিসের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় বার্থেলেমে-মারজুকা দম্পতি দত্তক নেন কুলসুমকে। দত্তকনামায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর থাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারীর। দত্তকনামায় উল্লেখ করা হয়, সুরক্ষা, শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন অনুসারে সম্পত্তির ভাগ ও সর্বোপরি সন্তান হিসেবে সব অধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে স্বেচ্ছায় কুলসুমকে দত্তক নিচ্ছেন বার্থেলেমে-মারজুকা দম্পতি। ২৩ জুলাই ১৯৭৭ সালে কুলসুমের নাম পরিবর্তন করে কুলসুম মারজুকা রেখে সব নিয়ম মেনে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সুইজারল্যান্ডে। এরপর সুইজারল্যান্ডে কাটতে থাকে তার দিনকাল। 

দীর্ঘ ৪৫ বছর স্বজনকে খুঁজে ফেরার হাহাকার তার মনে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। দীর্ঘ সময় পরিবারের শূন্যতা অনুভব করেছেন, স্মৃতিতে শুধু মাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন।

 

শেকড়ের খোঁজে বাংলাদেশে
১৯৭৭ থেকে ২০২১ সাল। দীর্ঘ ৪৫ বছর পর শেকড়ের খোঁজে স্বামী আন্দ্রে ম্যারিয়োকে নিয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে আসেন ম্যারিও কুলসুম। আবছা স্মৃতিতে খুঁজে ফিরছিলেন হারিয়ে যাওয়া আপনজনকে। কিন্তু কোথাও মিলছে না খোঁজ। কুলসুমও ঠিকমতো জানেন না, বাবা-মায়ের নাম। শুধু এটুকু জানেন, বাবা ফার্মাসিস্ট। ছোটবেলায় লঞ্চে করে মায়ের সঙ্গে ঢাকা এসেছেন চাচার বাসায়। এরপর তাকে রেখে যাওয়া হয় অনাথ আশ্রমে। আর কিছুই তার স্মৃতিতে নেই। প্রায় এক সপ্তাহে এদিক-ওদিক স্বজন খুঁজে বেড়ানোর পর কুলসুমের সহযোগিতায় নামেন সামাজিক সচেতনামূলক অনুষ্ঠান সাইবার লাইফের উপস্থাপক মুনজুরুল করিম। পুরান ঢাকা থেকে মোহাম্মদপুর—সবখানে খুঁজে বেড়িয়েছেন অনাথ আশ্রম; কিন্তু কোথাও মেলেনি যুদ্ধোত্তর সময়ের অনাথ আশ্রমের খোঁজ।

কুলসুম। ছবি: সংগৃহীত

আশোর আলো টিডিএইচ অনাথ আশ্রমে
অনেক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যায় ১৯৭২-এর পর মোহাম্মদপুর টিডিএইচ অনাথ আশ্রম থেকে পরিত্যক্ত শিশুদের তখনকার আইনে বিদেশিদের কাছে দত্তক দেওয়া হতো। সে সময়ের কাগজপত্র যাচাই করতে কুলসুমকে নিয়ে আসেন টিডিএইচ অফিসে। কিন্তু না, এখন থেকেও হতাশ হয়ে ফিরতে হলো, মিললো না স্বজনের খোঁজ। কর্মকর্তারা জানান, পুরাতন কোনো কাগজপত্র এখন আর নেই, সেসময়ের কর্মকর্তারাও এখন বয়োবৃদ্ধ; কারও স্মৃতিতে তেমন জানা নেই।

 

সোশ্যল মিডিয়ার কল্যাণে ভিডিওতে মিললো আশা
সব জায়গা থেকে যখন হতাশ হয়ে ফিরতে হলো, তখন এক প্রকার মনোবল হারিয়ে ফেলেন কুলসুম। কিন্তু আপনজনকে পাওয়ার বাসনা  তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে; এদিকে তার ছুটি ফুরিয়ে আসায় ফিরে যান সুইজারল্যান্ডে। এরপর কুলসুমের স্বজন খুঁজে ফেরানোর গল্প ধারাবাহিকভাবে মুনজুরুল করিমের ইউটিউব চ্যানেল প্রকাশিত হলে প্রযুক্তির কল্যাণে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে, সেখান থেকে বৃদ্ধ মাফিয়া বেগম জানতে পারেন কুলসুমের কথা। যোগাযোগ করেন মুনজুরুল করিমের করিমের সঙ্গে। মাফিয়া বেগমের দেওয়া তথ্য উপাত্ত প্রায় সব-ই মিলে যায় কুলসুমের আবছা জানা তথ্য উপাত্তের সঙ্গে। এখান থেকে এক প্রকার নিশ্চিত হওয়া গেলো মাফিয়া বেগম-ই কুলসুমের মা।

অবশেষে মায়ের কোলে ফেরা। ছবি: সংগৃহীত

পরিবারের সবার ডিএনএ টেস্ট
বৈজ্ঞানিক প্রমাণের জন্য সবার ডিএনএ টেস্ট করাতে সহযোগিতা চাওয়া হয় পুলিশের বিভাগে। তারাও সব শুনে সহযোগিতা করতে রাজি হন।  অবশেষে গত ৩১ জানুয়ারি মাফিয়া বেগম ও পুত্র সেলিমের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি সেই ফল আসে। আর কুলসুমের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয় সুইজারল্যান্ডে। দুটি রিপোর্ট সিআইডির ডিএনএ অ্যানালিস্টরা বিশ্লেষণ করে মিল খুঁজে পান। অবশেষে কুলসুমকে জানানো হয় সেই খুশির সংবাদ। পরিবারকে ফিরে পাওয়ার দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার অবসান ঘটে। এই প্রথম সিআইডি ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে দীর্ঘ বছর পর আত্মীয়তার বন্ধন উদঘাটন করেছে।

 

৪৫ বছর পর কুলসুমের 'মা' ডাক
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২। পূর্ব পরিকল্পনুযায়ী মুনজুরুল করিমের অফিসে আনুষ্ঠানিকভাবে ভিডিও কলে প্রথমবারের মতো পরিবারের সদস্যেদের সঙ্গে কথা বলানো হয় কুলসুমকে। বয়োবৃদ্ধ মাফিয়া বেগম মোবাইলফোন হাতে নিয়ে কাঁদছেন মোবাইলে অপরপ্রান্তে কাঁদতে কাঁদতে কুলসুম বলছে ‘মা, আই অ্যাম খুলসুম, ইউর ডটার খুলসুম (কুলসুম)’। মা-মেয়ের কান্না যেন ৪৫ বছরের জমিয়ে রাখা সব রাগ-ক্ষোভ-অভিমান-ভালোবাসার প্রকাশ দিচ্ছে।

 

৪৫ বছর পর প্রথমবার মায়ের বুকে কুলসুম
সন্ধান মিললো, নিশ্চিত হওয়া গেলো, ভিডিও কলে কথা হলো—এবার সরাসরি সাক্ষাতের পালা। দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর ফেরিয়ে সে কাঙ্ক্ষিত সময় এলো ৯ই এপ্রিল,  দুপুর এগারোটায়। এই সময়ে সাইবার লাইফ অফিসে মা-মেয়ের প্রথম সাক্ষাৎ। যেখানে মা-মেয়ে একে অন্যের জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, এই কান্না ৪৫ বছর চাপিয়ে রাখা স্বজন হারানোর বেদনার কান্না নয়, এ কান্না খুশির কান্না। স্বামী আন্দ্রে ম্যারিওকে নিয়ে কুলসুম ফিরেছেন গ্রামের বাড়িতে।

ইত্তেফাক/এসটিএম