বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রোজার ইতিহাস ও সামাজিক উপকারিতা

আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২২, ১১:২১

কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হলো, যেমন তোমাদের পূর্বেকার লোকদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল।’ এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মহানবি (স.)-এর পূর্ববর্তী উম্মতগণের ওপরও রোজা ফরজ ছিল। হজরত আদম (আ.) নিষিদ্ধ ফল খেয়ে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসতে বাধ্য হন। সেই সময়ে তার দেহের রং কালো হয়ে যায়। ফলে তার দুর্দশা দেখে ফেরেশতাগণ কেঁদে কেঁদে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করলেন, ‘হে আল্লাহ, আদম তোমার প্রিয় সৃষ্টি। তুমি তাকে জান্নাতে স্থান দিয়েছিলে, আমাদের দ্বারা তাকে সিজদাও করালে, আর একটি মাত্র ভুলের জন্য তার গায়ের রং কালো করে দিলে।’

তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা আদম (আ.)-এর কাছে এই ওহি পাঠালেন, ‘তুমি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখো।’ আদম (আ.) তা-ই করলেন। ফলে তার দেহের রং আবারও উজ্জ্বল হয়ে গেল। এই জন্যই এই তিনটি দিনকে উজ্জ্বল দিন বলে। ইবনে আব্বাস (আ.) বলেন, ‘রসুলুল্লাহ (স.) ঘরে ও সফরে এই উজ্জ্বল দিনে কখনো সিয়াম না করে থাকতেন না।’ (নাসায়ি মিসকাত)

এরপর হজরত নুহ (আ.)-এর যুগেও সিয়াম ছিল। প্রত্যেক মাসে পালন করা হতো তিনটি সিয়াম। এরপর হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর যুগে কয়টা রোজা ছিল, তার সঠিক কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি। ইব্রাহিমের (আ.) পরে বৈদিক যুগে বেদের অনুসারী ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও ব্রত অর্থাৎ উপবাস ছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রতি মাসে দুটি দিন উপবাস থাকেন। একটি শুক্লপক্ষে, অন্যটি কৃষ্ণপক্ষে। এই উপবাসকে একাদশীর উপবাস বলা হয়ে থাকে। হিন্দু যোগীরা কখনো কখনো ৪০ দিন পানাহার ত্যাগ করে চল্লিশে ব্রত পালন করেন।

হিন্দুদের মতো জৈনরাও উপবাস করেন। গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যেও জৈনরা কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতি বছরই উপবাস থাকেন। প্রাচীন মিশরীয়রাও উপবাস পালন করত। পারসিদের ধর্মগ্রন্থেও একটি শ্লোক দ্বারা বোঝায় যাচ্ছে যে, তাদের ধর্মেও উপবাস ছিল। বিশেষ করে তাদের ধর্মগুরুর জন্য পাঁচসালা উপবাস জরুরি ছিল।

ইব্রাহিম (আ.)-পর কিতাবধারী প্রসিদ্ধ নবি হজরত মুসা (আ.)। তার আমলেও সিয়াম ছিল। ইহুদিদের তাওরাতে আছে, মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে ৪০ দিন পানাহার না করে কাটিয়েছিলেন। তাই ইহুদিরা সাধারণত মুসা (আ.)-এর অনুসরণে ৪০টি সিয়াম রাখা ভালো মনে করত। এর মধ্যে ৪০তম দিনটিতে তাদের রোজা রাখা ফরজ ছিল। মুসা (আ.)-এর পর কিতাবধারী নবি ছিলেন হজরদ দাউদ (আ.) তার যুগেও রোজার প্রচলন ছিল। আল্লাহ রসুল (স.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় রোজা দাউদের (আ.) রোজা। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন এবং এক দিন বিনা সওমে থাকতেন। অর্থাৎ তিনি অর্ধেক বছর রোজা রাখতেন এবং অর্ধেক বছর বিনা সওমে থাকতেন।

দাউদ (আ.)-এর পর কিতাবধারী বিশিষ্ট নবি হলেন হজরত ঈসা (আ.)। তার যুগে এবং তার জন্মের আগেও রোজার প্রমাণ পাওয়া যায়। কোরআনে আছে, ঈসা (আ.)-এর যখন জন্ম হয় তখন লোকেরা তার মা মরিয়মকে তার জন্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমি করুণাময়ের উদ্দেশ্যে মানতের রোজা রেখেছি। সুতরাং আজকে আমি কোনো মানুষের সঙ্গে মোটেই কথা বলব না’ (সুরা মারইয়াম)। হজরত ঈসা (আ.) এর পর শেষ নবি হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর যুগ। তার নবি হবার পূর্বে আবরদের মুশরিকদের মধ্যে সিয়ামের প্রচলন ছিল। যেমন আয়িশাহ (রা.) বলেন, ‘আশুরার দিনে কুরাইশরা জাহিলি যুগে রোজা রাখতেন এবং রাসুল্লাহ (স.) জাহিলি যুগেও রোজা রাখতেন। অতঃপর তিনি যখন মদিনায় আসেন তখন ঐ রোজা নিজে রাখেন এবং সাহাবিদেরকে রোজা রাখার হুকুম দেন। পরিশেষে রমজানের সিয়াম যখন ফরজ হয় তখন তিনি আসুরার রোজা ছেড়ে দেন’ (মুসলিম ১১২৫ বুখারি)।

যাহোক, আমাদের ওপর রমজানের এক মাস সিয়াম ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ রমজান মাস পাবে সে যেন অবশ্যই সিয়াম পালন করে (সুরা বাক্কারা ১৮৫)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি মুসলিম একই সময়ে, একই উদ্দেশ্যে, একই নিয়ম মেনে সিয়াম ব্রত পালন করে থাকেন। আল্লাহর দৃষ্টিতে বিশ্বের সমস্ত মানুষই সমান। এই ধ্যানধারণাকে আরো জোরদার করে তোলে সিয়াম। প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, ধনী-গরিব তা যে দেশেরই হোক না কেন, উপোস থাকার একই অভিজ্ঞতা লাভ করে। এতে করে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ জাগরিত হয় এবং তা আরো মজবুত হয়।

এই সিয়াম গরিব ও দরিদ্রের প্রতি দয়া এবং সহানুভূতি প্রদর্শনের চেতনাকে জাগিয়ে তোলে। একজন ধনী ব্যক্তি একজন গরিবের দুঃখ-দুর্দশা ও কষ্ট সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করে। একজন ক্ষুধার্ত মানুষের কী কষ্ট, পেটের জ্বালা কী জিনিস তা সে পরতে পরতে অনুভব করে। সিয়ামের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা গরিব দুঃখী মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখে। সিয়াম পালনকারীরা একসঙ্গে বসে ইফতার করতে চরম তৃপ্তি ও আনন্দ পায়। তখন মুসলিমদের মধ্যে সমাজবদ্ধতার এক স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়, এই সিয়ামের কারণে। কাজেই সিয়ামের এই সামাজিক দিকগুলোও খুবই শিক্ষণীয় এবং বিশ্ববাসীর জন্য অনুসরণীয়।

লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা।

ইত্তেফাক/এমআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন