শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মানুষ হাই তোলে কেন

আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২২, ০৭:০০

প্রচলিত আছে—হাই দেখলেও হাই ওঠে। তার চেয়ে বড় কথা, হাই ওঠে কেন? কী কারণে মানুষ হাই তোলে। আবার, কেনই-বা হাই দেখে অন্যের হাই ওঠে!

সবাই হাই তোলে। ক্লান্ত হলে আমরা হাই তুলি। শরীর দুর্বল লাগলে হাই আসে। ঘুম পেলে আমাদের হাই আসতে চায়। এমনকি বিরক্ত হলে মুখ হাঁ করে হাই তুলি আমরা।

এমনও দেখা গেছে—গরমকালের চেয়ে শীতকালে হাই তোলে বেশি। বলা হয়—আপনি যখন হাই তোলেন, তখন কেবল মুখ খুলে হাই তোলেন না, আপনার পুরো শরীর হাই তোলে এবং মুখ দিয়ে সেটা কেবল জানান দেয়।

এক গবেষণায় এটাও দেখা গেছে যে, পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি হাই তোলেন। একজনের হাই দেখে নারীদের ৫৪ শতাংশ হাই তোলে, কিন্তু পুরুষের এমন হাই তোলার ছোঁয়াচে হার ৪১ শতাংশ।

শুধু কি নারী-পুরুষের এই ভেদাভেদ! হাই দেখে বুঝতে পারবেন পারসোনালিটি! মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে সাইকোপ্যাথ পারসোনালিটির লোকেরা হাই তোলে কম! কারণ, চারপাশের প্রতি তার সহানুভূতি কম। অথচ হাই হলো মস্তিষ্কের রিলাক্স প্রক্রিয়া, যা পরিবেশের সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরি করে। সাইকোপ্যাথ জাতীয় লোকদের ঠিক এই সংযোগটাই কম, অন্যের প্রতি অনুভবটাই কম।

হাই দেখলে কেবল হাই আসে না। হাই হলে অনেকের চোখে জলও আসে। হাইয়ের কারণে মুখের পেশিগুলো চোখের ভেতর চাপ দেয় বলে অশ্রুগ্রন্থিতে চাপ পড়ে এই জল বের হয়। হাই উঠলে মুখ চোখের সঙ্গে কানেও তার ইফেক্ট পড়ে। হাই চলাকালে কানে কম শুনতে পাবেন। এটি ঘটে কানের ভেতর টেনসর টিমপ্যানি নামক একটি পেশির কারণে।

একজনের হাই দেখলে আরেক জনের হাই আসে। হাসির মতো হাই তোলা একটি সামাজিক ছোঁয়াচে আচরণ। শুধু কি আরেক জনের হাই তোলা দেখলে আপনার-আমার হাই আসে? হাই শব্দটি পড়লেও হাই আসে অনেকের। এমনকি হাই তুলতে গিয়ে মৃতু্যও হতে পারে আপনার। ২০০৭ সালে ৩৪ বছর বয়সি এক ভদ্রলোক ঘুম থেকে উঠে চা বানাতে গিয়ে হাই তুলছিলেন। মুখ হাঁ করে আর বন্ধ করতে পারছিলেন না। আমরা যখন হাঁ করি, চোয়ালের একটি হাড় ম্যান্ডিবল নিচের দিকে নেমে যায়, মুখ বন্ধ করলে আগের জায়গায় ফিরে আসে। কাজটি সহজ করতে কানের কাছে মস্তিষ্কের খুলির হাড় টেম্পোরাল হাড়ের সঙ্গে ম্যান্ডিবল হাড়ের একটি জয়েন্ট কাজ করে। নাম : টেম্পেরোম্যান্ডিবুলার জয়েন্ট। এমন হাই দিতে গিয়ে এই জয়েন্ট আর মুভ করা না গেলে তাকে ‘জো লুকিং’ বলে।

অনেক দিন থেকেই বিজ্ঞানীদের কাছে ব্যাপারটি ধাঁধার। সর্বজন একমত এমন কোনো মীমাংসিত উত্তর নেই।

কেবল মানুষ হাই তোলে না, অন্য প্রাণীরাও হাই তোলে। কুকুর, বিড়াল, সাপ, পাখি ও বানর, বেবুন, শিম্পাঞ্জিরাও হাই তোলে। তবে পোকামাকড়েরা হাই তোলে না। মেরুদণ্ডী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এটি দেখা যায় বেশি। কিছু কিছু মাছ জলের ভেতরেও হাই তোলে। সাপের ভালো একটি ভোজনের পর হাই তোলে। একটি পেঙ্গুইন আরেকটি পেঙ্গুইনের আদর পেলে হাই তোলে। মানুষের মতো কুকুর কিংবা আফ্রিকান কিছু হাতি হাই দেখলেও হাই তোলে। প্রাণীদের পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বাঘ কিংবা সিংহদের মধ্যেও একজনের হাই দেখলে আরেকটি বাঘ কিংবা সিংহের হাই আসে ।

ইংরেজিতে হাই হলো ‘ইঅন’ । হাই তোলার অন্য একটি কঠিন বাংলা শব্দ আছে—জৃম্ভণ!

হাই একটি শরীরের ইনভলান্টারি অ্যাকশন। একটা অনৈচ্ছিক রিফ্লেক্স। এতে ফুসফুস ও কান একসঙ্গে কাজ করে। মুখ হাঁ হয়ে ফুসফুসে প্রচুর বাতাস ঢোকে, সেই বাতাস মুখ দিয়ে ফুসফুসে যাওয়ার সময় কানকে চাপ দেয়। কানের সঙ্গে গলার সংযোগী একটি টিউব আছে, ওটাকে বলে ইস্টাশিয়ান টিউব। এটি মধ্যকানের সঙ্গে নাক গলার একটি সংযোগ তৈরি করে। এজন্য সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে গেলে অনেক সময় কানও বন্ধ হয়ে যায় ! বাতাসের চাপে একদিকে বাইরের কানের ইয়ার ড্রাম প্রসারিত হয়। আরেক দিকে মধ্যকানের টেনসর টিম্পানি মাসলটি সংকুচিত হয়। এমন সংকোচনের কারণে হাই দিলে একটা মড়মড় শব্দ হয় চোয়ালে! এই শব্দ শেষ হতেই ফুসফুস থেকে একগাদা বাতাস বেরিয়ে আসে। গোটা প্রক্রিয়াটি যেন শরীরে বাতাসের একটি ঝড়। কখনো কখনো হাই তোলার সঙ্গে চোখে জল আসে, কানে একটি শব্দ বাজে, শরীরের কিছু মাসল এবং হাত-পাগুলো টানটান হয়ে ওঠে।

হাই তুললে শরীরে দুটো প্রক্রিয়া ঘটে। একটি শারীরিক। আরেকটি মানসিক।

শারীরিকভাবে মুখ খুলে যায়, অনেক বড় করে হাঁ করি আমরা। প্রচুর বাতাস ঢোকে তাতে। তারপর আমরা গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিই। সবশেষে একরাশ বাতাস ছাড়ি।

কখন হাই তোলে বেশি মানুষ। ঘুম থেকে উঠে কিংবা ঘুমাতে যাওয়ার সময়। ঘুমের প্রস্ত্ততি নিই। তার পরও হাই আসে। ক্লান্তিতে হাই আসে। মানসিক অস্বস্তিতে অনেকক্ষণ থাকলে হাই আসে। ঘন ঘন হাইয়ের সঙ্গে শারীরিক কিছু সমস্যা জড়িত। যদি প্রতি মিনিটে একটি করে হাই আসে, ধরে নিতে হবে শরীরে কোনো সমস্যা চলছে। তখন এটি শুধু ক্লান্তি বা ঘুমের কারণে হয় না।

এমন অন্যতম একটি হলো ভেসোভেগাল রিঅ্যাকশান। ভেগাস নার্ভ অতিরিক্ত স্টিমুলেটেড হলে এই ভেসোভেগাল রিঅ্যাকশন হয়। তাতে হাই তোলা অত্যধিক পরিমাণ বেড়ে যায়, সঙ্গে হার্ট রেট কমে যায়, ব্লাড প্রেশার অনেক কমে যেতে পারে। প্রয়োজনের তুলনায় কোনো কারণ ছাড়াই অধিক পরিমাণে হাই তুললে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

লেখক :চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক, ইংল্যান্ড

ইত্তেফাক/ইউবি 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন