শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বাড়তি দাম নির্ধারণের জন্যই কারসাজি

আপডেট : ০৭ মে ২০২২, ০০:২৭

ভোজ্য তেলের বাজারে আগে থেকেই অস্হিরতা ছিল, দামও ছিল বাড়তি। গত দুই বছর ধরে প্রায় একই অবস্হা। কিন্তু হঠাৎ করেই বাজার থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে সয়াবিন তেল, পাম অয়েল। এ যেন তেল নিয়ে তেলেসমাতি কারবার। কিন্তু হঠাৎ করে বাজার থেকে তেল উধাও হওয়ার কারণ কী? ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ইন্দোনেশিয়া গত বৃহস্পতিবার থেকে পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। আর্জেন্টিনাও সয়াবিন তেল রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এজন্যই কি ভোজ্য তেলের বাজারের এ অবস্হা। না কি এর পেছনে অন্য কারণ আছে?

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি মাসে সয়াবিন, পাম অয়েলের যে দর নির্ধারণ করে দেয়, তা একটি মহলের পছন্দ নয়। তাদের দাবি, ব্যবসায়ীরা নিজেরাই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারে সয়াবিন, পাম অয়েলের দর নির্ধারণ করবেন। গত বৃহস্পতিবার ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দিলে এই সুযোগটি নেয় একটি চক্র। তারা বাজার থেকে সয়াবিন তেল, পাম অয়েল উধাও করে দেয়। রাতারাতি হুহু করে দাম বাড়তে থাকে সয়াবিন তেল, পাম অয়েলের। অনেকটা বেকায়দায় পড়ে যায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বেশি বিপাকে পড়েন ভোক্তারা। 

অবস্হা এমন হয় যে, চাহিদামতো তেল না পেয়ে অনেকে ঈদে তাদের পছন্দমতো রান্না পর্যন্ত করতে পারেননি। পরে বাধ্য হয়ে বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্য তেলের নতুন দর নির্ধারণ করে। সূত্রটি জানিয়েছে, নতুন যে দর নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে দেশের বাজারে তেলের দাম বেশি। তেল সিন্ডিকেটের দাবি অনুযায়ী নতুন এ দর নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন দর অনুযায়ী খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১৮০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকা ও পাম সুপার ১৭২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

রাজধানীর মৌলভীবাজারের পাইকারি ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী মো. আলী ভূট্টো ইত্তেফাককে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল, পাম অয়েলের দাম বাড়তি থাকলেও গত দুই দিনে কমেছে। গত দুই দিনের ব্যবধানে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ১৫০ ডলার কমে ১ হাজার ৮৫০ ডলার ও পাম অয়েল প্রায় ১০০ ডলার কমে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৬৫০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।

মৌলভীবাজারের এ পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, যদি কোনো বড় ঘটনা না ঘটে তাহলে দাম আর বাড়বে না। তাহলে দেশের বাজারেও দাম কমবে।

এদিকে গতকাল শুক্রবারও রাজধানীর কাওরান বাজার ও তুরাগ এলাকার নতুন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন করে পরিবেশকরা বাজারে সয়াবিন তেল সরবরাহ করেনি। একই অবস্হা পাম অয়েলের ক্ষেত্রেও। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কোম্পানির পরিবেশক ও পাইকারদের কাছে থেকে তারা তেল পাচ্ছেন না। অথচ মিলে যথেষ্ট পরিমাণে তেল মজুত আছে। কাওরান বাজারের জব্বার স্টোরের বিক্রেতা আজিজুল জানান, পরিবেশকরা যদি তেল সরবরাহ না করে তাহলে আমরা কীভাবে বিক্রি করব?

সরকারের বিপণন সংস্হা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গতকাল তাদের বাজারদরের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাজারে পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ৯৫০ থেকে ৯৮৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ১৯৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

অথচ রমজানের শুরুতে পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ৭৫০ থেকে ৭৬০ টাকা ও এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

কিন্তু গত এক মাসের ব্যবধানে কী এমন হলো যে, বাজার থেকে ভোজ্য তেল উধাও হওয়ার মতো অবস্হা হয়েছে? এ প্রশ্ন ভোক্তাদের। গতকাল তুরাগ এলাকার নতুন বাজারে সয়াবিন তেল কিনতে আসা রেজাউল করিম বলেন, আমরা তো ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছি। এক বছর আগে খোলা সয়াবিন তেল কিনেছি ১১০ টাকায়। এখন তা কিনছি ২০০ টাকায়। তা-ও পাওয়া যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশের ভোজ্যতেলের বাজার মূলত আমদানিনির্ভর। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ ও আর্জেন্টিনা রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে ভোজ্য তেলের বাজার হুহু করে বাড়ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। তবে বর্তমানে দেশের বাজারে যে সয়াবিন, পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে তা আগের আমদানি করা। এখনই ইন্দোনেশিয়ার পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধের প্রভাব বাজারে কেন পড়বে? সংশ্লিষ্টরা বলেছে, এটা কারসাজি ছাড়া আর কিছুই না। এক শ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী কারসাজি করে অধিক মুনাফার লোভে হুহু করে তেলের দাম বাড়াচ্ছে।

সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বাজারে প্রতিদিন যে পরিমাণ তেল সরবরাহ করা হচ্ছে তাতে তো কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়। সরবরাহ ব্যবস্হার কোনো স্তরে সমস্যা আছে কি না, তা খুঁজে বের করতে হবে।

উল্লেখ্য, দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখ টন সয়াবিন তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে ৬৫ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়। এ ছাড়া সয়াবিন বীজ মাড়াই করেও প্রতি মাসে ২৮ হাজার টন সয়াবিন তেল উত্পাদন করা হয়। আর প্রতি বছর পাম অয়েলের চাহিদা প্রায় ১৩ লাখ টন। এই চাহিদার ৯০ শতাংশ আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। বাকিটা আসে মালয়েশিয়া থেকে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির আগে দেশের আমদানিকারকরা এপ্রিল মাসেই প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টন পাম অয়েল আমদানি করেছেন। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইন্দোনেশিয়ায় কমপক্ষে ২০ হাজার টন পাম অয়েল আমদানির চালান আটকে গেছে। তবে যেহেতু নিষেধাজ্ঞার আগে এলসি করা হয়েছে তাই এই তেল আসবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, দেশে যথেষ্ট পরিমাণে সয়াবিন তেল, পাম অয়েল মজুত রয়েছে। এখন যেহেতু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাড়তি দরে তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করেছে তাই এক সপ্তাহের মধ্যে বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন