জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ইংরেজি বিভাগের ২০১৬-১৭ বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী অঙ্কন বিশ্বাসের মৃত্যু নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে অঙ্কনের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন তার সহপাঠী ও বিভাগের শিক্ষার্থীরা। অঙ্কনের মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করছেন তার সহপাঠীরা।
জানা যায়, অঙ্কন স্নাতক ফলাফলে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়সহ টেলিভিশনের ভালো বিতার্কিক। বিতর্কের সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির সাবেক সভাপতি ও আইন বিভাগের ২০১১-১২ বর্ষের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। গত ২২ মার্চ প্রথমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন অঙ্কন। পরে একই দিনে শাকিলের সঙ্গে বিয়ে করেন তিনি। তবে কিছুদিন না যেতেই এ সম্পর্কে বিপত্তি দেখা দেয়। বিষয়টি মীমাংসার জন্য গত ২৪ এপ্রিল শাকিলের বাসায় যান অঙ্কন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে নেন তিনি। পরে হাসপাতাল থেকে অঙ্কনের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আব্দুল মুকিত চৌধুরী সানীকে ফোনে খবর দেওয়া হয়। সেখানে সপ্তাহ খানেক চিকিৎসার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ১ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়। এরপর গত রবিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
অঙ্কনের বন্ধু সানী বলেন, ‘২৪ এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে আজগর আলী হাসপাতাল থেকে অঙ্কন অসুস্থ বলে একটা ফোন আসে। পরে সেখানে গিয়ে অঙ্কনকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখতে পাই। ডাক্তাররা তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় হাসপাতালে শাকিল ও তার ভাই হিমেলকে দেখতে পাই। শাকিল ভাই ও বন্ধুর পরিচয়ে ভর্তি করাতে চাইলে প্রথমে ভর্তি করায়নি কর্তৃপক্ষ। পরে স্বামী পরিচয়ে ভর্তি করান।’ তিনি আরও বলেন, ‘শাকিল প্রথমে ঘটনা বলতে চাইছিলেন না। পরে বলেন, বাসা থেকে হয়ত কিছু খেয়ে তার বাসায় এসেছে অঙ্কন। সেখানে কথা বলার একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে যান।’
আজগর আলী হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ এপ্রিল দুপুর ২টায় হাসপাতালে অঙ্কনকে নিয়ে আসে শাকিল আহমেদ ও তার এক বন্ধু। শুরু থেকেই অবস্থা ক্রিটিক্যাল হওয়ায় এটাকে পুলিশ ফাইল করা হয়েছে। আইসিইউতে তার চিকিৎসা চলছিলো। অবস্থার অবনতি হলে গত ১মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) স্থানান্তর করা হয়।
তার সহপাঠী কাওসার আহমেদ রোহান জানান, হঠাৎ করেই অঙ্কনের ব্রেইন স্ট্রোক এবং হার্টফেইল হয়। তারপর অক্সিজেন ঠিক মতো নিতে পারছিলো না, যার কারণে শরীরের বিভিন্ন অর্গান নিস্তেজ হওয়া শুরু করেছিলো। শুরু থেকেই ওর অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল ছিলো। যার ফলে অঙ্কনকে পুরোপুরি লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এদিকে অঙ্কনের চিকিৎসা চালিয়ে নিতে বিভাগের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা ফান্ড সংগ্রহ করে আসছিলেন।
এদিকে অঙ্কনের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন তার সহপাঠী ও বিভাগের শিক্ষার্থীরা। অঙ্কনের মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে জেবা সাজিদা মৌ লিখেন, ‘অংকনের মৃত্যুটা অপমৃত্যু বলে আমরা মনে করি। অঙ্কনকে হাসপাতালে ভর্তি করায় ওর বয়ফ্রেন্ড আর এক বন্ধু। অঙ্কন সেন্সলেস হয় ওর বয়ফ্রেন্ডের বাসাতেই। মানুষের সাধারণ টেনডেন্সি হল আপনজনের বিপদে পাশে দাঁড়ানো। আমরা অঙ্কনের বয়ফ্রেন্ডকে পাশে পাই নাই। আমরা সিনিয়র-জুনিয়র যখন ওর ফান্ডিং এর জন্য প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছিলাম তখন ওর বয়ফ্রেন্ডের কাজ কী ছিল?’
তবে গত ২২ মার্চ অঙ্কনের সঙ্গে শাকিলের কোর্ট ম্যারেজের একটি হলফনামা ইত্তেফাকের হাতে আসে। বিয়ের বিষয়ে আইনজীবী মিরাজ আকন বলেন, ‘প্রথমে মেয়েটি এফিডেভিট করে মুসলমান হয়। তারপর বিয়ে করে। তিনজনের সাক্ষ্য ওখানে আছে।’
অঙ্কনের বাবা তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘শাকিলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কি না আমরা কিছুই জানতাম না। এখন লোকমুখে শুনছি। বিয়ে হলে তো আমাদেরকে জানাতো। আমার মেয়ে এমন না। বিয়ের কাগজপত্রগুলো জালও হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এরকম কিছু জানলে আমি ব্যবস্থা নিতাম। আমার মেয়ে মরেই যাবে, বাবা হিসেবে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি না।’
এসব বিষয়ে অঙ্কনের স্বামী শাকিল আহমেদ বলেন, ‘অঙ্কন আমাদের বিয়ের বিষয় পরিবারে জানানো নিয়ে ডিপ্রেশনে ছিলো। আমি তাকে মানসিকভাবে সাপোর্টও দিচ্ছিলাম। ঘটনার দিন সকালে সে ফোন দিয়ে আমার বাসায় আসে। বাসায় ঢোকার কিছুক্ষণ পরই ও চোখে অন্ধকার দেখছে বলে পড়ে যায়। আমি ওর মাথায় পানি দেই, শরবত করে খেতে দেই। কিন্তু ওর কোনো রেসপন্স না পেয়ে পরবর্তীতে হাসপাতালে নিয়ে আসি। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর ওর ব্যাগে নীল পদার্থ মিশ্রিত একটা বোতল পাওয়া যায়। ডাক্তার বলেছে, ওর পয়জন ওভারডোজ হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওর পরিবার খুবই কনজারভেটিভ। ওর বাবাকে খুব ভয় পেতো। ও হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলো? আমার জানা নে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এই বিষয়টা শুরু থেকেই আমাদের জানা আছে। পরিবার থেকে যদি কোনো সহযোগিতা চায়, আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো।’
রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবু সাঈদ আল মামুন বলেন, ‘এ ঘটনায় একটা পুলিশ ফাইল হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে যদি কোনো অভিযোগ দেওয়া হয় তাহলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।’