বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০২৩, ৮ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল নিয়োগ প্রক্রিয়া!

আপডেট : ২১ মে ২০২২, ০৪:৩০

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ৫১৩টি পদের লিখিত পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে ডিবি পুলিশের তৎপরতায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় কয়েক জনকে গ্রেফতারের পর মাউশি এই সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ পরীক্ষার কার্যক্রম নিয়ে শুরু থেকেই নানা বিষয়ে বিতর্ক ওঠে। এ সব বিতর্ক ও নানা প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে নিয়োগ কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হয়।

শুরুতেই প্রশ্ন ওঠে নিয়োগ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে। যিনি সভাপতি হয়েছেন, তিনি এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন কিনা? ২০১৯ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ কমিটির পাঁচ সদস্যের একজন ছিলেন অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী। সে সময় ‘৩০-এ সাড়ে ৩’ পাওয়া এক প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করে কমিটি। তখন প্রায় ২০ লাখ টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। পরে সেই নিয়োগ বাতিল করা হয়। এমনকি নিয়োগ কমিটির সদস্যদের ভবিষ্যতে কোনো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটির সদস্য না করার জন্য আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ ৪ হাজার ৩২টি পদে নিয়োগ কমিটির ‘আহ্বায়ক’ করা হয়েছে ঐ  কর্মকর্তাকেই। এ কারণেই শুরু থেকেই প্রশ্নের মুখে পড়ে ঐ নিয়োগ কার্যক্রম।

নিয়োগ কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক)। দ্বিতীয় শ্রেণির পদকে তৃতীয় শ্রেণি দেখিয়ে নিয়োগ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে দুদক ঐ তদন্ত শুরু করে। এর আলোকে দুদক সরেজমিনে গিয়ে তথ্যও সংগ্রহ করছে। যার তদন্ত এখনো চলছে। তদন্তের বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে চালিয়ে যাওয়া হয় নিয়োগ কার্যক্রম। যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারাই প্রশ্ন তুলেছে।

নিয়োগে নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ ডিসেম্বর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীরকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ৭ ডিসেম্বর থেকে তাদের কাজ শুরু করে। তবে তদন্ত কাজ চলার পর ৮ ডিসেম্বর তদন্তকাজ বন্ধের নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে অনিয়ম খোঁজা মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর ঐ সময় জানিয়েছিলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেছিলাম। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠনের আদেশটি প্রত্যাহার করেছে। এ জন্য আমাদের তদন্ত কাজ বন্ধ আছে।

নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) মো. রুহুল মোমিন। নানা অনিয়মের অভিযোগে রুহুল মোমিনকে বদলি করা হয়, তার স্থলাভিষিক্ত হন বিপুল চন্দ বিশ্বাস। তিনিও আগের ধারাবাহিকতায় নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। মাউশির ঐ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ পুলিশের হাতে পাঁচ জন গ্রেফতার হন। এর মধ্যে সদস্য সচিবের অফিসের কর্মচারী দুই জন।

তথ্য অনুযায়ী, সরকারি কলেজে ১০টি বিষয়ের প্রদর্শক, গবেষণা সহকারী, সহকারী গ্রম্হাগারিক-কাম-ক্যাটালগার, ল্যাবরেটরি সহকারীর পদগুলো দশম গ্রেডের। এ ধরনের ৬১০টি পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী, দশম থেকে দ্বাদশ গ্রেড পর্যন্ত দ্বিতীয় শ্রেণির পদ। মাউশির নিয়োগবিধিতে এই পদগুলোকে তৃতীয় শ্রেণির দেখিয়ে শুধু এমসিকিউ পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির পদ হলে সে পরীক্ষা নেবে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। 

গত বছরের নভেম্বরে মো. পিন্টু শেখ নামের এক ব্যক্তি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ করেন। সেখানে তিনি বলেন, সরকারি কলেজে বিভিন্ন বিষয়ের প্রদর্শকরা পরে পদোন্নতি পেয়ে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত প্রভাষক হন। এমনকি তাদের অধ্যাপক হওয়ারও সুযোগ রয়েছে। অথচ এ ধরনের পদে ৭০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। নিয়োগ কমিটির অনেকেই এ ব্যাপারে একমত না হলেও নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) বাদ দিয়ে খাতা দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডকে। অথচ নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ঢাকা বোর্ড চত্বরেই থাকেন। এ বিষয়টি নিয়ে খোদ শিক্ষকদের মধ্যেই নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ঢাকা বোর্ডে চাকরি করায় এবং এখনো ঐ চত্বরে থাকায় বোর্ডের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে আহ্বায়কের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। ফলে এ ক্ষেত্রে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন, এত অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এর দায় থেকে নিয়োগ কমিটির সভাপতি ও সদস্যসচিব কী দায় কোনোভাবে এড়াতে পারেন? তবে এ বিষয়ে নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব বিপুল চন্দ বিশ্বাস বলেন, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দুই জন আমাদের মাউশির কর্মচারী। কিন্তু তারা নিয়োগের কোনো কাজে জড়িত ছিল না। এ কারণে এর দায় সদস্য সচিবের ওপর বর্তাবে কেন?

সূত্র জানায়, ২০২০ সালের অক্টোবরে ২৮টি পদে ৪ হাজার ৩২ জনকে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় মাউশি। এতে আবেদন করেন ৮ লাখ ৯৭ হাজার ৪৯ জন।

ইত্তেফাক/এএইচপি