শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৭ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিদ্রোহী কবিতার পৌরাণিক আবেদন

আপডেট : ২৭ মে ২০২২, ১০:১৬

বাঙালি জাতির ইতিহাস চিরায়ত দ্রোহের ও সংগ্রামের ইতিহাস। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জর্জরিত ও পর্যুদস্ত মানুষের মনের মর্মন্তুদ বেদনার স্মারকলিপি হয়ে যখন রচিত হচ্ছে একের পর এক ঘুমপাড়ানি গান, জাতির মহা ক্রান্তিলগ্নে বাংলা সাহিত্যের মহাকাশে ধূমকেতুর মতো আবিভূ‌র্ত হন এক হাবিলদার কবি। প্রতিবাদের খাতায় সমস্ত হিসেবের খসড়া একত্র করে অভিনব ছন্দে ও শব্দে রচনা করেন বিদ্রোহী নামের অপূর্ব এক কবিতা। তাঁর বিদ্রোহ কেবল পরাধীনতার বিরুদ্ধে নয়, বরং সকল অন্যায়-অত্যাচার, শাসক, শোষক ও নিপীড়কের বিরুদ্ধে। 

কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় পৌরাণিক উপকথার উল্লেখযোগ্য সমাবেশ লক্ষ করা যায়। অত্যাচারীকে দমন করতে কবি শক্তি ও ধ্বংস রূপে কখনো রুদ্র, কখনো ভৃগু, ভীম, ধুর্ঝটি, অগ্নি, হোম শিখা, জমদগ্নি, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, চক্র ও মহাশঙ্খ, পিনাক পাণির ডমরু ত্রিশুল, ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র, ধর্মরাজের দণ্ড, রাহু, উচ্চৈঃশ্রবা, বাসুকির ফণা, ছিন্নমস্তা চণ্ডী, পরশুরামের কঠোর কুঠার, হল বলরাম-স্কন্ধে এবং বিদ্রোহী ভৃগুর সাজে নিজেকে চিত্রিত করেছেন। আবার পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর, পথিক কবির গভীর রাগিণী, হাম্বির, ছায়ানট ও হিন্দোল হয়ে নব যৌবনের সুরে নিজেকে আবদ্ধ করেছেন। নজরুল একটি কবিতার ভেতর হিন্দু মিথলজি, গ্রিক এবং ইসলামি ঐতিহ্য ছাড়াও ঐতিহাসিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব, প্রাকৃতিক ও মহাকাশ জগতের বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করেছেন। আরবি-ফারসি, ইংরেজি শব্দরাশির সঙ্গে ইসলামিক ও সেমিটিক ঐতিহ্য, দেব, দানব, মানব, প্রকৃতি, নিসর্গ, সমাজ, লৌকিক ভাবজগতের শব্দের মিলন ঘটিয়ে এক অভূতপূর্ব কাব্যধারা সৃষ্টি করেছেন। 

বিদ্রোহী কবিতায় একদিকে যেমন দেশি পৌরাণিক গাথা আছে অন্যদিকে ভিনদেশি গাথা থেকেও উপমা গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি কি আধ্যাত্মিকভাবেই এতসব বিষয় জানতেন, নাকি বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এই জ্ঞানের উত্স কোথায়?

১৯০৮ সালে নজরুলের পিতা মারা যান। পিতার মৃতু্যর পর পরিবারে অভাব ও দুর্গতি নেমে আসে। ১৯০৯ সালে নজরুল মক্তবের নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করেন। মাত্র দশ বছর যে মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পাশ করেন সে মক্তবেই শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করেন। এছাড়াও আশপাশের স্হানীয় মহল্লা ও গ্রামে মোল্লাগিরি করেছেন। এর মাঝে পাহলোয়ানের মাজার শরিফের খাদেমগিরিও করেন। নিজের গ্রামের মসজিদে ইমামতির কাজও। তাঁর চাচা কাজী বজলে করিম ফারসি সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি নিয়মিত ফারসি কাব্যচর্চা করতেন। তাঁর কাছে ফারসি ভাষার হাতেখড়ি হয়। কাজী বজলে করিমের সহযোগিতা ও প্রেরণায় নজরুল ফারসি-উর্দু ভাষার মিশ্রণে একটি কবিতা লেখেন।

মেরা দিল বেতাব কিয়া
তেরি আব্রুয়ে কামান;
জ্বলা যাতা হ্যায়
ইশ্ক্-মে জান পেরেশান,
হেরে তোমায় ধনি,
চন্দ্র কলঙ্কিনী
মরি, যে বদনের শোভা।
মাতোয়ারা প্রাণ
বুলবুল করতে এসেছে
এই মধু পান

এই কবিতার মাধ্যমেই লেখার জগতে নজরুলের হাতেখড়ি হয়। ১২ বছর বয়সে তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন। তৎকালে লেটো গানের দলে হিন্দু পৌরাণিক ও ঐতিহ্য নিয়েই অধিকাংশ গাথা রচিত হতো। আর এসবের চাহিদা ছিল প্রচুর। তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিন্দু পৌরাণিক ও ঐতিহ্য নিয়েই লেটোর সদস্যরা গান বাঁধত। নজরুল ছন্দ মিলিয়ে গান করতে পারতেন। তাই লেটোর সর্দার নজরুলের হাতে মহাভারত, রামায়ণ, উপনিষদ, বেদসহ অন্যান্য গ্রন্থ তুলে দেন। নজরুল ধর্মগ্রন্থসমূহ পাঠ করে নিত্যনতুনভাবে লেটো গানের দলে উপস্হাপন করতেন। তিনি লেটোর দলে গান এবং পালা রচনা করেন। রামায়ণ, মহাভারতের বিভিন্ন মিথ নিয়েও গান রচনা করেছেন। লেটোর দলে তিনি ‘চাষার সং’, ‘শকুনি-বধ’, ‘মেঘনাদ-বধ’, ‘রাজপুত্র’ প্রভৃতি পালা রচনা করেন। ‘শকুনি বধ’-এর একটি গান

শিবা হয়ে পরাজিতে পশুরাজে সাধ।
জ্ঞান নাই কি তোর কাণ্ডাকাণ্ড
হয়েছিস উন্মাদ !
অজা হয়ে কোন সাহসেতে
ভেক হয়ে ফণীর সাথে বাধ
বাধ সাধিস্ মহাবলী বাঘের সাথে,
তুমি বাধ!

মসজিদের খাদেম হিসেবে কবি বাল্যকালেই ইসলামি ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেছিলেন। লেটো গানের শুরুতেও বন্দনা গান গেয়ে পালা শুরু করতেন। লেটো দলের বন্দনা গান

সর্বপ্রথমে বন্দনা গাই তোমারই ওগো ‘বারিতালা’
তারপর দরুদ পড়ি “মুহাম্মদ” ‘সাল্লে আলা’ ।
সকল পীর দেবতাকুলে
সকল গুরুর চরণ মূলে
জানাই সালাম হস্ত তুলে
দোওয়া কর তোমরা সবে হয় যেন গো মুখ উজালা
সর্বপ্রথমে বন্দনা-গাই তোমারই ওগো বারিতালা।
তোমারই ওগো খোদাতালা।

লেটো গানের দলে কাজ করার সুবাদে হিন্দুধর্ম এবং হিন্দু সংস্কৃতির পৌরাণিক ঐতিহ্য সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন। সেইসঙ্গে ইহুদি এবং খ্িরষ্টানদের ধর্মগ্রন্থও তাঁর পঠিত ছিল।

রুবাইয়াৎ-ই হাফিজ মুখবন্ধে কবি বলেন, আমি তখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি। ১৯১৭ সালের কথা। সেখানে আমার হাফিজের সাথে পরিচয় হয়। আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন মৌলভী থাকতেন। একদিন তিনি দ্বীওয়ান ই-হাফিজ থেকে কতগুলো কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। শুনে আমি এমন মুগ্ধ হয়ে যাই যে, সেদিন থেকে তাঁর কাছে ফারসি শিখতে আরম্ভ করি। তাঁরই কাছে ক্রমে ফারসি কবিদের প্রায় সমস্ত কাব্যই পড়ে ফেলি।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় সকল প্রকার অন্যায়-অত্যাচার-শোষণ-নিপীড়ন-অসাম্যের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। এই বিদ্রোহ ঘোষণার মাধ্যমরূপে গ্রহণ করেছেন পুরাণকে।

কাজী নজরুল ইসলামের অমোঘ সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বাংলাভাষায় এক নতুন ধারার সূচনা করেছে। বিদ্রোহী কবিতা আজন্ম নতুন, এই কবিতার আবেদন সর্বজনীন এবং সর্বকালীন। শুধু শত বছর নয়, সহস্র বছর পরেও বিদ্রোহী কবিতা চির অম্লান থাকবে। যতদিন মনুষ্যধামে অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণের করাঘাতে ‘উৎপীরিতের ক্রন্দনরোল’ বাজবে ততদিন এই বিদ্রোহীর ফিনিক্স থেকেই জন্ম নেবে শত শত বিদ্রোহী। বিদ্রোহী মহাসিন্ধুর দ্বাররক্ষী হিসেবে চির উন্নত শিররূপে বিরাজমান থাকবে।

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন