বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কচা নদীর তীরে স্লুইসগেট-বেড়িবাঁধ, স্বস্তিতে এলাকাবাসী 

আপডেট : ২৮ মে ২০২২, ১৭:১৫

প্রমত্তা বলেশ্বর নদের মুখ এবং শাখা কচা নদী তীরবর্তী উপকূলীয় অঞ্চল পিরোজপুরের ভারিয়া উপজেলায় বেড়িবাঁধ এবং স্লুইসগেট নির্মাণকাজ দ্রুত গতিতে চলছে। এতে স্বস্তি প্রকাশ করছেন নদমুলা, ধাওয়া, ইকড়ি, চরখালী, হেতালিয়া, সাফা, বোথলা, জুনিয়া, হরিনালা ও তেলিখালী ইউনিয়নের মানুষ। বিশেষ করে নদী তীরবর্তী জেলে এবং কৃষক পরিবারগুলো স্বস্তি প্রকাশ করছে। 

শনিবার (২৮ মে) সরেজমিনে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দারা ধান চাষের পাশাপাশি মৌসুমি সবজি চাষ করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা মুরগির ফার্ম, কলা ক্ষেত, মৌসুমি রবি শস্যের মাঠ দেখলে যেন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। 

এসময় কথা হয় জেলেপল্লী এবং কৃষক পরিবারের আদি বাসিন্দাদের মধ্যে আল আমিন বয়াতি (৫২), নুর মোহাম্মদ (৬৫), দুলাল জোমাদ্দার (৪২), আজীজ হাওলাদার (৭০), রহিম বয়াতি (৬৫), মনোয়ারা বেগম (৬০) হাবিব (৩৫) মিজানসহ (২৮) বেশ কয়েকজন যুবক, বৃদ্ধ নারী-পুরুষের সঙ্গে। 

তারা বলেন, মোগো (আমাদের) বাপ দাদার এই জাইল্লা কাম (পেশা সাগরে মাছ শিকার) করইয়া (করে) খাই। নদী ভাঙন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস যেন ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী! কৃষির ফলন ভালো হলেও অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে তা বিনষ্ট হয়ে যেত।

একসময়ে যাদের জীবন কাটতো ভয়ে, আজ তারা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, আমাগো (মোদের) এমপি (সংসদ সদস্য) আনোয়ার মঞ্জু (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি) মোগো লইগ্গা (আমাদের জন্য) যা করে হ্যার জন্য মোরা (তার জন্য আমরা) দোয়া হরি, হে যেন আরও একশো বছর বাইচ্চা থাকে (সে যেন আরও শত বছর বেঁচে থাকেন)। 

বেড়িবাঁধ এবং স্লুইসগেটের কারণে কচা তীরবর্তী প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার পরিবারের মানুষের মধ্যে অধিকাংশই জেলে এবং কৃষক খুশিতে জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখছেন। ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর, তারপর আইলাসহ বেশ কয়েকটি ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যার কবলে পড়ে নিজেরা কোনোভাবে জীবন বাঁচাতে পারলেও গরু, ছাগল ছাড়াও গাছপালা বিনষ্ট হয়েছে। বিব্ধস্ত হয়েছে বাড়িঘর। 

স্থানীয় ইউপি সদস্য সাকায়েত হোসেন সিপাই বলেন, ‘এ অঞ্চলে আগে এক ফসল চাষ করা হতো। বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে এখন বছরে তিনবার ফসল উৎপাদন করে থাকে কৃষকরা। আমার (সাকায়েতের) নিজেরই ধান ওঠার পর এবছর মরিচের ব্যাপক উৎপাদন হয়েছে।’

কচা নদীর তীরে নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধ। ছবি: ইত্তেফাক

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বা.পা.উ.বি) অধিনে উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান নেদারল্যান্ডের বয়াল হাসকনিংয়ের তত্বাবধানে চায়না নির্মাণ প্রতিষ্ঠান চংকিং ইন্টারন্যাশনাল কনস্ট্রাশন করপোরেশনের (সিকো) বাস্তবায়নে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প সি.ই.আই.পি-১,প্যাকেজ-২ এর কাজ চলমান রয়েছে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ৬টি পোল্ডারে পৃথকভাবে কাজ শুরু হয়। এ গুলো হলো পোল্ডার নম্বর-৩৯/২সি (ভাণ্ডারিয়া-পিরোজপুর), পোল্ডার ৪০/২ (পাথরঘাটা-বরগুনা), পোল্ডার ৪১/১ (বরগুনা), পোল্ডার নম্বর-৪৩/২সি (গলাচিপা-বরগুনা), পোল্ডার নম্বর-৪৭/২ (কলাপাড়া-পটুয়াখালি) ও পোল্ডার নম্বর-৪৮ (কয়াকাটা-কলাপাড়া-পটুয়াখালি) এ ৬টি পোল্ডারে পৃথকভাবে কাজ চলছে। 

এর মধ্যে পোল্ডার নম্বর-৩৯/২সি (ভান্ডারিয়া-পিরোজপুর) প্যাকেজে ভান্ডারিয়া উপজেলার থানা ইকোপার্ক সংলগ্ন হাসপাতাল লাগোয়া কচাঁ নদীর ০ কিলোমিটার দক্ষিণ শিয়ালকাঠী থেকে শুরু করে নদমুলা ইউনিয়নের দক্ষিণ শিয়ালকাঠী, ধাওয়া ইউনিয়ন, ঝালকাঠীর কাঠালিয়া উপজেলার ভগিরথপুর, মহেশখালী, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ধানিসাফা, ভান্ডারিয়া উপজেলার জনিয়া, হরিনপালা, তেলিখালী, ইকড়ি ইউনিয়নের বোথলা-হেতালিয়া, ভায়েলা বুনিয়া, নদমুলা শিয়ালকাঠী ইউনিয়নের চরখালী, চিংগুরিয়া, লঞ্চঘাট হয়ে শুরু স্থানে মিলিত হবে।

শনিবার দুপুরে পোল্ডার ৩৯/২সি (ভান্ডারিয়া-পিরোজপুর) প্যাকেজ কাজের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের কনস্ট্রাশন সুপারভিশন ইঞ্জিনিয়ার (সিএস,ই) মো. ছাদেকুল ইসলাম জানান, এ প্যাকেজের আওতায় ৫৯.২৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ১৩টি ড্রেনেজ স্লুইস, ২১টি ফ্লাসিং  স্লুইস, ৩.৫০ বিভার ব্যাংক প্রটেকশনের কাজ, ৪.০ কিলোমিটার ইমব্যাকমেন্ট প্রটেকশনের কাজ ও ৫৭.২৩ কিলোমিটার খাল খনন/পুনঃখননের কাজ চলমান আছে। পোল্ডার ৩৯/২সি প্যাকেজের প্রায় ৭৫ শতাংশ এ পর্যন্ত অগ্রগতি সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ স্বাভাবিক গতিতে চলমান আছে। 

তিনি আরও জানান, ৫৯.২৫০ কিলোমিটার বাধের মধ্যে প্রায় ৩০ কিলোমিটার নির্মিত হয়েছে। ১৩টি ড্রেনেজ স্লুইসের মধ্যে ১২টির নির্মাণকাজ প্রায় সম্পন্ন, ২১টি ফ্লাসিং স্লুইসের মধ্যে ৭টির নির্মাণকাজ প্রায় সম্পন্ন। এ ছাড়া, ৩.৫০কিলোমিটার বিভার ব্যাংক প্রটেকশন কাজের প্রায় ৯৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এবং প্যাকেজের অন্যান্য নির্মাণকাজ স্বাভাবিক গতিতে চলমান আছে। এই কাজে প্লাসেটিংয়ের কাজে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৩ লাখ সি.সি ব্লক তৈরি ও ডাম্পিং এবং প্লেসিংয়ের কাজ প্রায় ৯০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। বেড়িবাঁধের ঢালে বনায়নের কাজও প্রায় ১০ শতাংশ করা হয়েছে। বাকি কাজ চলমান আছে।

এদিকে ২/১টি স্থানে বেড়িবাঁধের বাইরে নদীর তীরে কিছু জেলে পরিবারের কাঁচা বাড়িঘর আছে, যা বাঁধের ভেতরে পুনর্বাসন করতে পারলে আর কোনো অসুবিধা হতো না বলে শিয়ালকাঠী বাঁধ এলাকার জেলে হারুনার রশিদের দাবি।

ইত্তেফাক/এএইচ