শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশ্ব পরিবেশ দিবস

পরিবেশ সুরক্ষায় আইন আছে, প্রয়োগ নেই

আপডেট : ০৫ জুন ২০২২, ০৯:২২

পরিবেশ বিপর্যয়ের তালিকায় পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ ভয়াবহ সংকটের দিকে যাচ্ছে। দেশে পরিবেশ দূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড় হওয়া, যেখানে সেখানে ইটভাটা, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, দ্রুত শিল্পায়ন, সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, ওজোন স্তরের ক্ষয়, অ্যাসিড বৃষ্টি, অপরিকল্পিত গৃহনির্মাণ, দারিদ্র্য, প্রসাধনসামগ্রী ও প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।

গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৭ ভাগ। শুধুমাত্র বায়ু দূষণে ক্ষতি হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। দূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার হয় শিশুরা। দেশে প্রতি বছর ২৮ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে দূষণজনিত অসুস্থতায়। পরিবেশ সুরক্ষায় দেশে আইন থাকলেও তা যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। এই পটভূমিতে আজ রবিবার (৫ জুন) বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ রোধ ও পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পালিত হচ্ছে ‘পরিবেশ দিবস’। এ বছরের প্রতিপাদ্য- ‘একটাই পৃথিবী: প্রকৃতির ঐকতানে টেকসই জীবন’।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন’ রয়েছে। পরিবেশদূষণ-সংক্রান্ত অপরাধের বিচার করার জন্য এ দেশে তিনটি পৃথক আদালতও রয়েছে। কিন্তু এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলে পরিবেশদূষণ-সংক্রান্ত অপরাধগুলো যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। দেশের তিনটি পরিবেশ আদালতে বর্তমানে মামলা রয়েছে ৭ হাজার ৩০টি। এর মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে দায়ের করা মামলার সংখ্যা মাত্র ৩৮৮, যা মোট মামলার মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। আদালতগুলো স্থাপন করা হয়েছে পরিবেশ দূষণসংক্রান্ত অপরাধের বিচার করার উদ্দেশ্যে, অথচ সেগুলোয় এ-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাই সবচেয়ে কম।

যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির পরিবেশ রক্ষায় পারদর্শিতা সূচক-২০২০ অনুযায়ী, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২ তম। শিল্পায়নের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা দেশ থাইল্যান্ড, চীন ও ভিয়েতনাম এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এমনকি পাকিস্তান ও নেপালও সূচকে বাংলাদেশের ওপরে। ভারত অবশ্য বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে। পরিবেশসংক্রান্ত ১১টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সূচকটি তৈরি করা হয়।

ঢাকার পরিবেশ আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের মামলায় কারাদণ্ড কম। বেশির ভাগ মামলায় আদালত আসামিদের আর্থিক দণ্ড দিয়েছেন। গত ১০ বছরে নিষ্পন্ন হওয়া ২০০ মামলার মধ্যে ১৪৭টি মামলার আসামিকে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বাকি মামলায় আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন।

কেবল পরিবেশ আদালতেই নয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সারা দেশে যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়, সেখানেও অর্থদণ্ড বেশি দেওয়া হয়। কারাদণ্ডের মতো সাজা দেওয়ার সংখ্যা কম। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে দেশে ৪ হাজার ৪৪০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কারাদণ্ড দেওয়া হয় মাত্র ১৬৬ জনকে। অবৈধ পলিথিন জব্দ, অবৈধ ইটভাটা, কালো ধোঁয়া, শব্দদূষণ, পাহাড় কাটা, জলাশয় ভরাট, নির্মাণসামগ্রী দিয়ে পরিবেশদূষণসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে এই দণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, পরিবেশ আদালতে সাধারণ মানুষ অথবা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সরাসরি মামলা করতে পারে না। কেউ মামলা করতে চাইলে প্রথমে অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ জানাতে হয়। প্রতিকার না পেলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতে মামলা করতে পারেন।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের ব্যত্যয় করছেন, তাহলে ক্ষতি নির্ধারণ করে তা পরিশোধের নির্দেশ দিতে পারবেন। ক্ষতিপূরণ না দিলে মহাপরিচালক আদালতে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারবেন। এ নির্দেশ অমান্য করলে ফৌজদারি মামলা করা যাবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিবেশ আদালতে মামলা কম হওয়ার অন্যতম একটি কারণ সরাসরি মামলার সুযোগ না থাকা। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এ জন্য আইন সংশোধনের দাবি করেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বিদ্যমান আইনে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি সরাসরি আদালতে মামলা করতে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক বাধার সম্মুখীন হন। এ বাধা দূর করতে হবে। আইন সংশোধনের মাধ্যমে পরিবেশসংক্রান্ত সব অপরাধের বিচারের ক্ষমতা পরিবেশ আদালতকে দেওয়া জরুরি।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। পরিবেশ রক্ষা করতে গেলে অধিদপ্তরকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নেতা অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি আইন রয়েছে, তার প্রয়োগ দরকার। দেশের বিদ্যমান আইনে পরিবেশ রক্ষায় অনেক কিছু করা সম্ভব। বাংলাদেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অ্যাডভোকেসি করে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে হবে। আমরা নিজেদের দায়িত্ব ঠিক মত পালন করলে বাস্তবায়নকারী সংস্থা এবং কর্মকর্তারাও সঠিক পথে চলতে বাধ্য।’

এদিকে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত শহরাঞ্চলে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে যত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তাদের ২৮ শতাংশই মারা যাচ্ছেন পরিবেশ দূষণজনিত নানা রোগের কারণে। আর শহরাঞ্চলে নানা দূষণের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) বলেছে, বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরানো, বুড়িগঙ্গা নদীকে দূষণমুক্ত করা ও ঢাকা শহরের জলাশয়, খাল দখল করে গড়ে ওঠা আবাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাবরোধে পাবলিক টয়লেট বিষয়ক সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে ১২টি সুপারিশ করেছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।

দূষণ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক ল্যানসেট কমিশনের নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণ ও সিসার বিষক্রিয়ায় ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর প্রায় ৯০ লাখ মানুষ মারা গেছেন। তাদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মারা গেছেন বায়ুদূষণে।

অনলাইন জার্নাল ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথে প্রকাশিত এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, সারাবিশ্বে প্রতি ৬ জনে একজন দূষণের কারণে মারা গেছেন। যুদ্ধ, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি, যক্ষ্মা বা মাদকের কারণে বার্ষিক বৈশ্বিক মৃত্যুর চেয়ে এ হার বেশি। দূষণের কারণে মৃত্যুর হার গত ২ দশকে ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা এর পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে।

ইত্তেফাক/এসজেড