শিশুদের বলা হয় স্বর্গের দূত। শিশুরা সবে যখন এক পা, দুই পা হাঁটতে শেখে, তার মুখে যখন আধো আধো বুলি ফোটে তখন এক আশ্চর্য মমতায় মন ভরে যায় বাবা-মায়ের। শুধু কি বাবা মা! শিশু তার পবিত্র হাসি দিয়ে আদর কেড়ে নেয় সবার। ঘর করে আলোকিত। বড়দের দেউলিয়াতে আজ প্রাণচঞ্চল সে শিশুরা সাক্ষী হচ্ছে ভয়াবহ বাস্তবতার।
শিশুদের আজ কেউ কেউ মায়ের কোল হারা, কারো কারো মাথা গোঁজার জন্য নেই কোন আশ্রয়। বড়দের মতোই নিজের শরীরের রক্ত জল করে গড়ে নিচ্ছে জীবন, হাল ধরছে সংসারের। তবু তারা এ অসম সমাজ-রাষ্ট্রে থাকে অবাঞ্ছিত। রাষ্ট্রের ডায়েরিতে তাদের লেখা হয় পথশিশু। তারা আজ কোন পথে?
১১ বছরের রসুলপুরের তানভীর এমনি এক শিশু। পাঁচ সদস্যদের পরিবারের একজন সে। সকাল ৭টা-রাত ১০টা পর্যন্ত দিনের ১৫ ঘণ্টা অতিবাহিত হয় লেগুনার পেছনে ঝুলতে ঝুলতে। কায়িক পারিশ্রমিক হিসেবে দৈনিক দুই থেকে তিনশত টাকা পায়। তার ইচ্ছে পড়াশোনা করর, স্বপ্ন শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু কে তার এ ইচ্ছা পূরণ করবে?
দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জীবনের স্বর্ণালি সময়টুকু জড়িয়ে গেছে তার। শিশুর সবচেয়ে কাছের স্বজন বাবা-মায়ের কথামতো ঘরের বাইরেই কাটাতে হচ্ছে তানভীরকে। ‘‘কোন দিন যদি কামে না আহি তহন মায় কয়, ‘ঘরে থাইক্কা কি করবি, ঘরে থাহন লাগবো না।’’ কৌতুহল আর বিস্ময় নিয়ে বলে যায় তানভীর।
তানভীর বলে, ‘কামে একদিন না আইলে মাহাজনে বহা দেয়।’ স্কুলে না গেলে শিক্ষক হবে কীভাবে জানতে চাওয়ার পর-মুহূর্তেই দু গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট নিয়ে তানভীর বলতে থাকে, ‘আমারও ত মন চায় বন্ধুগো লগে খেলতে যাইতে। ইচ্ছে করে স্কুলে যাইতে, কিন্তু পারি না তো।’
চার ভাই-বোনের মধ্যে একজন তামিম। বছরখানেক কাজ করছে পরিবহনের (অটোমোবাইল) পার্টসের দোকানে। স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললো, ‘কি বলবো..? ডাক্তার হওন তো কহনো পূরণ হইবো না৷’
অভাবের তাড়নায় ঝুঁকি নিয়েই দিনের প্রায় ষাট ভাগ সময় তামিমকে শ্রম দিতে হচ্ছে পার্টসের দোকানে। অল্প বয়সেই হারিয়েছে বাবা। করোনার পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। জটিল সব কাজ তার সঙ্গী। ‘করোনার পর লেহাপড়া বাদ দিয়া দিছি। কাজ কইরাই খাইতে হইবো।’ বললো তামিম।
তানভীর আর তামিমের মতো দেশে এমন ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ, যার মধ্যে ঢাকা অংশেই রয়েছে ৪০ শতাংশ। এসব শিশুরা জানে না ভবিষ্যৎ তাদরে জন্য কী অপেক্ষা করছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০১৩-এর সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, ১২ বছরের ঊর্ধ্বে অর্থাৎ ১২-১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকি-হীন কাজ করে তাদের কর্মরত শিশু হিসেবে ধরা হয়। এ শ্রম অনুমোদন-যোগ্য। তবে ১২ বছরের নিচে অর্থাৎ ৫-১১ বছর বয়সী কোন শিশু যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচিত হবে। তারাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে পড়ে যায়। আর ৫-১৭ বছর বয়সি কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয় এমন ধরনের প্রায় ৩৮টি কাজকে সরকার ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং এ ধরনের কাজে শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
মায় কয়, ঘরে থাইক্কা কি করবি, ঘরে থাহন লাগবো না...আমারও ত মন চায় বন্ধুগো লগে খেলতে যাইতে। ইচ্ছে করে স্কুলে যাইতে, কিন্তু পারি না তো...
![]()
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)’র সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী- বর্তমানে বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে অন্তত ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাকিল আখতার চৌধুরী শিশুশ্রম প্রতিরোধের অগ্রগতি সম্পর্কে বলেন, ‘শিশুশ্রম রোধে বেশ কিছু কাজ এগিয়েছে সরকার। আইনের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু পরিবর্তন এসেছে।’
তিনি জানান, গত মার্চে ‘আইএলও কনভেনশন-১৩৮’ কে সমর্থন জানিয়েছে বাংলাদেশ। ওই ধারা অনুযায়ী ১৪ বছরের নিচে কোন শিশু কাজ করার অনুমতি পাবে না। এছাড়া ওই সময় শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে শিশুশ্রম নির্মূল করা হবে।
শ্রম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত শাকিল আখতার চৌধুরী বলেন, ‘অগ্রগতি এভাবেই এগুচ্ছে। সুতরাং ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান থেকে একেবারেই যে পরিবর্তন হয়নি তা বলা যাবে না। এমনকি মাঠ পর্যায়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি আছে সেটাও ঠিক বলা যাবে না৷ তবে কিছু কাজও হয়েছে এটা সত্যি।’
কি বলবো..? ডাক্তার হওন তো কহনো পূরণ হইবো না৷... করোনার পর লেহাপড়া বাদ দিয়া দিছি। কাজ কইরাই খাইতে হইবো...
![]()
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা সবসময় একটা কথা বলে থাকি যে ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। শিশু বড় হয়ে সমাজের প্রগতি ও উন্নয়নে কাজ করবে। শিশুর চোখে আমরা ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে দেখি। এজন্য শৈশবকাল থেকেই তাকে শিক্ষা, খাদ্য, পুষ্টি, নিরাপত্তা, নৈতিকতা ও সুন্দর পরিবেশের সুযোগ দিতে হবে। শিশুকে বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। আমরা যদি তাদের সুযোগ না দেই তাহলে তারা অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশে শিশুকে রাষ্ট্রের সম্পত্তি মনে করা হয়। এই সম্পত্তি রক্ষায় তারা নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। শিশুশ্রম শিশুর বঞ্চনাকেই নির্দেশ করে। শিশুকে তার যথাযথ অধিকার থেকে বঞ্চিত করেই আমরা তাকে কাজে লাগিয়ে দেই। শিশুর শৈশবের বঞ্চনা থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে’।
শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকার শাসন ‘সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ’র পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘শিশুশ্রম নিরসনে শিশুশ্রম মাথায় রেখে সমাধান খোঁজার চেষ্টা যতটা করা উচিত তার থেকে বেশি উচিত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা। গ্রাম বলুন শহর বলুন প্রাথমিক স্কুলগুলো যদি নিশ্চিত করতে পারে- বিদ্যালয়ের বাইরে সংশ্লিষ্ট এলাকার কোন শিশু নেই, তাহলে শিশুশ্রম শুরুতেই প্রতিরোধ হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘একটা শিশু ২-৪-৫ বছরের মতো কাজ করে ফেলে, তাতে তার একটা অর্থনৈতিক সক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। তখন তাকে আবার স্কুলে ফিরিয়ে আনাটা অনেক কঠিন হয়ে যায়। কাজেই শুরু থেকে যদি শিশুশ্রম প্রতিরোধে জোর দেওয়া যায় তাতেই মঙ্গল। এমনকি স্থানীয় সরকার এবং শিক্ষা প্রশাসন যদি জবাবদিহিতার আওতায় আসে তাহলেও ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব।’
প্রতিবছরের মতো এ বছরও পালন হচ্ছে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। করোনা পরবর্তী সময়ে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করি, শিশুশ্রম বন্ধ করি।’ দিবসটি পালন উপলক্ষে আইএলও, ইউনিসেফসহ দেশি-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচি পালনে এসব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।