জনপ্রতি স্বাস্থ্যসেবা বাবদ কত শতাংশ আউট-অব-পকেট (OOP) ব্যয় হয়, এই জরিপে ৭৩ শতাংশ ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করছে, যা প্রতিবেশী দেশ ভারত (৫৫ শতাংশ) ও পাকিস্তানের (৫৪ শতাংশ) চাইতেও বেশি। উন্নত দেশগুলোতে অথবা যেসব দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে সেসব দেশে এই হার ২০ শতাংশের নিচে। একইভাবে, স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় জিডিপির কত শতাংশ সেদিকে নজর দিলেও আমরা দেখি এখানেও মাত্র ২ শতাংশ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে নিচে (উভয় দেশের হার ৩ শতাংশ)। অর্থাৎ, সরকারি এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় আমাদের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিমার বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই শূন্যস্থান পূরণ করে সর্বজনীন স্বাস্হ্যব্যবস্হার পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। বিষয়টিকে আরো ভালোভাবে দেখা যাক।
স্বাস্থ্যবিমা হচ্ছে (সাধারণভাবে) একজন ব্যক্তির চিকিৎসা খরচের সম্পূর্ণ বা কিয়দংশ বহন করাকে বোঝায়। বাংলাদেশে এটি একেবারেই উদীয়মান পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে প্রায় ১৭ কোটি জনগণের দেশে স্বাস্থ্যবিমা পায়, এমন সংখ্যা কয়েক হাজার মাত্র। বাংলাদেশে শুধু নন-লাইফ ইনসিওরেন্স-সম্পন্ন ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যবিমার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়, আর বিপুল জনগোষ্ঠী এ ব্যাপারে অবহিত নয় এবং এর আওতার বাইরে।
যেসব দেশ এই ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে তাদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মডেল। এই ধারার এক পিঠে রয়েছে তারা, যেসব দেশের জাতীয় সরকার ও কেন্দ্রীয়ভাবে জনগণের চিকিত্সাব্যয়ের এই বিশাল ভার বহন করে থাকে, উদাহরণস্বরূপ : যুক্তরাজ্য, NHS অথবা কিউবার সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা-ব্যবস্থা। আবার অন্যদিকে, মালটি-প্লেয়ার বা মালটি-প্রোভাইডার সিস্টেম, যেমন জার্মানি/The Bismarck ব্যবস্থা।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যেও কোনো কোনো দেশ তাদের জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বেশ ভালো ব্যয়ভার বহন করে। ২০০২ সালে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচি চালু করার পর থাইল্যান্ড তার দেশের পাবলিক হাসপাতালগুলোর নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে সরকারের তিনটি স্কিমের মাধ্যমে সব থাই নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করে; ক. বেসামরিক কর্মচারী ও তাদের পরিবারের জন্য সিভিল সার্ভিস ওয়েলফেয়ার ব্যবস্থা, খ. বেসরকারি কর্মচারীদের জন্য সোশ্যাল সিকিউরিটি, গ. সব থাই নাগরিকদের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা। কিছু বেসরকারি হাসপাতাল এই কর্মসূচির অংশগ্রহণকারী। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য স্কিমের অধীনে ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ থাই নাগরিক স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকে। কিউবান সিস্টেমে সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত, জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা পরিচালিত হয় সরকার দ্বারা। বেশ কয়েকটি স্তরে বিন্যস্ত এই সিস্টেম; ১. ফ্যামিলি ২. ডক্টর অ্যান্ড নার্স টিম, ৩. বেসিক ওয়ার্ক টিম, ৪. কমিউনিটি পলিক্লিনিক ৫. হাসপাতাল এবং ৬. মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশন। মজার ব্যাপার হলো, ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ও নার্স টিম ব্যক্তি, তার পরিবার ও তাদের কমিউনিটির সেবা করে, যে কমিউনিটির সেবা প্রদান করে তাদের সঙ্গে সরকার নির্মিত ফ্যামিলি মেডেসিন অফিসে বাস করে এবং ২৪ ঘণ্টা তাদের সেবা চালু থাকে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে প্রায় সমিল আছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের, সেখানে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যবিমার ক্ষেত্রে গত দশকে খুব অল্প কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আয়ুষ্মান ভারত প্রধানমন্ত্রী জান আরোগ্য যোজনা বা অই চগ-ঔঅণ হচ্ছে ভারত সরকারের জাতীয় গণস্বাস্থ্যবিমা ফান্ড। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠিত এই ফান্ডের লক্ষ্যমাত্রা ১০ কোটি পরিবার বা ৫০ কোটি জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ। অধিভুক্ত হাসপাতালগুলোতে প্রতি বছর প্রতিটি পরিবারের জন্য ৫ লাখ রুপি (৭ হাজার ডলার) করে চিকিৎসা খরচ ধরা হয়েছে। অধিভুক্ত হাসপাতালের সংখ্যা ২৫ হাজার—যার মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি দুটোই অন্তভুর্ক্ত। এর আওতায় আছে হাসপাতালে ভর্তির পূর্বে তিন দিনের, হাসপাতালে ভর্তির পরে ১৫ দিনের চিকিৎসা ব্যয়—যার মধ্যে থাকবে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষানিরীক্ষা ও ওষুধপত্রের খরচ। বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতাল এ কর্মসূচিতে যোগ দিলেও অনেক বেসরকারি করপোরেট হাসাপাতাল এতে অংশ নেয়নি। প্রাইভেট হাসাপাতালগুলো রিপোর্ট দেয় যে, তারা সরকার-নির্ধারিত এত স্বল্পখরচে তাদের উচ্চমানসম্পন্ন সেবা প্রদানে অপারগ, সরকারি ভর্তুকি থাকা সত্ত্বেও।
কী করার দরকার? প্রথমত এবং সবার আগে প্রয়োজন স্বাস্থ্যবিমা কার্যকরের লক্ষ্যে একটি সংবিধিবদ্ধ কাঠোমো গঠন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যবিমার জন্য জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অর্থের (বর্তমানে ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ) সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য সরকারের তরফ থেকে একটি ঘোষণা আসা দরকার। পাশাপাশি চাকরিজীবীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা প্রদানকারী চাকরিদাতাদের সরাসরি কর সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে বিমার ব্যাপ্তি বাড়ানো যেতে পারে। চাকরিদাতা ও চাকরিজীবী উভয়ের অবদানের ভিত্তিতে একটা কর্মচারী স্বাস্থ্যবিমা ফান্ড গঠন করার লক্ষ্যে উপযোগী বিধিমালা প্রণয়ন করা যায়। একইভাবে সরকারি কর্মচারীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা (শুধু চিকিত্সাভাতার বদলে) চালু করতে পারে সরকার, এতে অন্যরাও এটি অনুসরণ করতে উত্সাহিত হবে। আবার, বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যারা স্বেচ্ছায় স্বাস্থ্যবিমার কোনো স্কিম গ্রহণ করবে তাদের আয়করে বিশেষ অর্থসুবিধা প্রদান একটি ভালো পদ্ধতি হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য খাতকে বিমা স্কিমের আওতায় আনতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্হাগুলোকে সরকারের তালিকাভুক্ত করে ফেলতে হবে। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক (১৫ হাজারের বেশি) এবং জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের মধ্যে জাতীয় নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করা হবে। এই সেবা প্রদানকারীরা পালাক্রমে সংযুক্ত হবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জেলা ও ছোট শহরগুলোর জেনারেল হাসপাতালগুলোর সঙ্গে। মেট্রো ও বিভাগীয় শহরগুলোতে অবস্থিত স্পেশালাইজড হাসপাতাল (মালটি স্পেশালিটি ও সুপার স্পেশালিটি) সমূহকেও তালিকাভুক্ত করা হবে বড় বড় ও জটিল ব্যাধি এবং সার্জারির জন্য।
মোটকথা, এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে রোগীর তথ্যমালা সংগ্রহ ও সব পর্যায়ে সহজেই অভিগমনের জন্য আন্তঃকার্যক্ষমতাসম্পন্ন তথ্য-উপাত্ত থাকা অতীব জরুরি। তথ্য বিশ্লেষণ এবং সংরক্ষণের জন্য সাধারণ নীতিমালা থাকা দরকার। রোগীর তথ্য এবং চিকিত্সাসংক্রান্ত রেকর্ড থাকলে তা একদিকে যেমন সেবাপ্রদানকারীদের মধ্যে সময়ানুবর্তিতা ও চিকিৎসার মান বাড়াবে; তেমনি অন্যদিকে, এরকম জাতীয় তথ্যভান্ডার বিমা কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যমালা একীভূত করতে ভূমিকা রাখবে।
আরো যা প্রয়োজন তা হলো, সেবাগ্রহীতাদের পদমর্যাদা ও বেতনের ওপর ভিত্তি করে একটা জাতীয় গ্রেডিং সিস্টেম (অ, ই, ঈ ক্যাটাগরি) করে ফেলা। সেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি এর ফলে সুলভ ও সহজলভ্য চিকিত্সাব্যয়ের প্ল্যাটফরম তৈরি হবে। কাজেই, জেনারেল প্র্যাকটিশনার থেকে শুরু করে কমিউনিটি ক্লিনিক এবং অভিজাত হাসপাতাল সবক্ষেত্রের সেবাদাতাদের অংশগ্রহণে এ কর্মসূচি সফল হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ল্যাবএইড