রংপুর বিভাগের ৮ জেলা ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে। কোনো ঘোষণা ছাড়াই শুরু হয়েছে ঘন ঘন লোডশেডিং। এক-দুদিন নয়, টানা পাঁচদিন ধরে এ অবস্থা চলছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎ মিলছে। বাকি সময়টা লোডশেডিংয়ে হাঁপিয়ে উঠছে জনজীবন।
রংপুর বিভাগের পুরো ৮ জেলার নগর-বন্দর, হাট-বাজার ও গ্রামে বিদ্যুৎ নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন গ্রাহকরা। একবার লোডশেডিং হয়ে তা কখনো কখনো তিন থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হচ্ছে। এই অব্যাহত সমস্যার কারণে বিভাগের শত শত বড়-ছোট বিদ্যুৎ ভিত্তিক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভরা মৌসুমেও শপিংমল ও বিভিন্ন দোকানে বিদ্যুতের অভাবে ক্রেতা কমে গেছে।
এদিকে, আষাঢ় মাসের গরমের কারণে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ১৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. জাবেদ বলেন, ‘গরমে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে রবিবার দুপুর পর্যন্ত ১১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।’
রংপুরের বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, জাতীয় গ্রিড থেকে চাহিদার তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ পাওয়ায় ঘন ঘন লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। তবে অবস্থা স্বাভাবিক হতে কত সময় লাগবে তা জানাতে পারেননি কর্মকর্তারা।
রংপুর বিদ্যুৎ বিভাগের নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রকৌশলী বলেছেন, রংপুর বিভাগে পিক আওয়ারে বিকাল ৫টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নেসকো ও পল্লী বিদ্যুৎ মিলিয়ে চাহিদা রয়েছে ৭০০ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রিড থেকে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০০ মেগাওয়াট। ফলে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করে রেশনিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
রংপুরের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, রংপুর বিভাগে তিন দিন ধরে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না।
রংপুর নগরীতে আরও ভয়াবহ অবস্থা। বিদ্যুতের অভাবে শপিংমলসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। প্রচণ্ড গরমে মানুষ প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হচ্ছে না।
রংপুর প্রেসক্লাব মার্কেটের ব্যবসায়ী মইনুল ইসলাম জানান, বিদ্যুৎ যায় কিন্ত কখন আসবে তা কেউ বলতে পারে না। একদিকে প্রচণ্ড গরম, অন্যদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবন বিপর্যস্থ।
রংপুর জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী মমতাজ উদ্দিন বলেছেন, ‘লোডশেডিং আর প্রচণ্ড গরমে মার্কেটে বেচাকেনা নেই। কয়েক দিন পর ঈদ। এখন বেচাকেনার ধুম পড়ার কথা, কিন্ত ক্রেতা নেই।’
রংপুর নগরীর মুনশি পাড়ার গৃহবধূ রাশেদা আক্তার বলেন, ‘সরকার বলছে দেশে বিদ্যুতের সংকট নেই, তাহলে কেন এত লোডশেডিং?’
বিদ্যুতের অনিয়মিত লোড শেডিংয়ের কারণে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থী।
নীলফামারী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার সুলতান নাছিমুল হক জানান, জেলায় পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা ৭০ মেগাওয়াট। বর্তমানে ৩০ থেকে ৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। গ্যাস ও জ্বালানি সংকটের কারণে সারাদেশেই লোডশেডিং হচ্ছে। সবকিছু বিবেচনা করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে।
নেসকো লিমিটেডের পরিচালন ও সংরক্ষণ সার্কেল-২ রংপুরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ‘নীলফামারী জেলায় আমাদের চাহিদা ৬৭ মেগাওয়াট। আমরা পাচ্ছি ৩৫ থেকে ৪০ মেগাওয়াট।’
রংপুর নগরীর হাজীপাড়া চামড়াপট্টি এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রমজান আলী বলেন, ‘গত ১০ বছরে এভাবে কখনো বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করেনি। বিদ্যুৎ কখন যাবে আর কখন আসবে তাও বলা মুশকিল। তীব্র গরম আর লোডশেডিংয়ে জীবন শেষ। দোকানে বসে থাকাও সম্ভব হচ্ছে না। অসহ্য লোডশেডিংয়ের কারণে দুই দিন দোকান বন্ধ রেখেছিলাম।’
রংপুর জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটের মোবাইলের মেকানিক আবু সায়েম লাভলু বলেন, ‘লোডশেডিং আর গরমে মার্কেটের অবস্থা খুবই খারাপ। জেনারেটর দিয়ে কতক্ষণ থাকা যায়। আগের মতো এখন কাজও করতে পারছি না। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ইলেকট্রিকসামগ্রী নষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ঈদ প্রস্তুতি মাটি হয়ে যাবে।’
গাইবান্ধা জেলার পৌর শহরে কিছুটা কম হলেও গ্রাম পর্যায়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে লোডশেডিং। একবার বিদ্যুৎ গেলে আসতে অন্তত ৪-৫ ঘণ্টা সময় নিচ্ছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ফ্রিজ, টিভি, ফ্যানসহ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় দারুণ ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। কোমলমতি শিশুসহ বয়স্ক লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ জনজীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে।
গাইবান্ধা শহরের আলমদিনা সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী স্বপন কুমার বলেন, ‘আমার প্রেসের ব্যবসা। বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা একেবারে অচল। অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারছি না। কোনো কোনো সময় মেশিন চালু করার আগেই বিদ্যুৎ চলে যায়। এতে আমার ব্যবসার অনেক ক্ষতি হচ্ছে।’
রংপুরের নেসকোর প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেনের সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘রংপুর বিভাগে নেসকো আর পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। দিনের বেলায় রংপুর বিভাগে বিদ্যুতের চাহিদা ৬০০ মেগাওয়াট। সরবরাহ পাওয়া যাচ্চে সর্বোচ্চ ৪০০ মেগাওয়াট। সন্ধ্যার পর থেকে চাহিদা ৭০০ মেগাওয়াট। পাওয়া যাচ্চে সর্বোচ্চ ৫০০ মেগাওয়াট।’
এ অবস্থা সাময়িক দাবি করে প্রকৌশলী বলেন, ‘আশা করি দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’