শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পরিকল্পনা ছাড়াই ইভিএম কিনে বিপাকে ইসি

আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২২, ০৮:০২

পরিকল্পনা ছাড়াই তাড়াহুড়া করে ক্রয় করা দেড়লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে বিপাকে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রতিটি ২ লাখেরও বেশি টাকায় কেনা এই ইভিএম সংরক্ষণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। দেড়লাখ ইভিএমের মধ্যে ৬৫ হাজার বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) ওয়্যারহাউজে সংরক্ষিত রয়েছে। তবে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও বিএমটিএফের গুদাম ভাড়া পরিশোধ করছে না ইসি। অন্যদিকে গুদাম ভাড়ার জন্য কোনো বরাদ্দ না থাকায় বাকি ৮৫ হাজার ইভিএম মেশিন সংরক্ষণ করা হয়েছে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা নির্বাচন অফিসে। এসব ইভিএমের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না, নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো প্রহরী।

বিএমটিএফ সংশ্লিষ্টরা ইত্তেফাককে বলেন, বিএমটিএফের ওয়্যারহাউজে যে ৬৫ হাজার ইভিএম সংরক্ষণ করা হয়েছে, তার ভাড়া পরিশোধ করতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। কারণ প্রকল্প প্রস্তাবে ইভিএম সংরক্ষণে গুদাম ভাড়া খাতে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ওয়্যারহাউজ ভাড়া বাবদ বকেয়া হয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। মাসিক সাড়ে ৯৭ লাখ টাকা ভাড়ায় বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) গুদামে ইভিএমগুলো মজুত করা হয়েছে। ইভিএমগুলো ২০১৮ সাল থেকেই বিএমটিএফে সংরক্ষিত থাকলেও উভয়পক্ষের আলোচনায় ভাড়া কার্যকর করা হয় ২০১৯ সাল থেকে।

ইসি সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের আগেই ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে ইভিএম কেনে ইসি। ঐ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ইভিএমের বিরোধিতা করলেও পিছু হটেনি বিগত কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। এজন্য নেওয়া হয় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। সিদ্ধান্ত হয় ২ লাখ ২০ হাজার ইভিএম ক্রয়ের। ইভিএম কেনার প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুনে শেষ হচ্ছে। এই প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। তবে রাজস্ব খাত থেকে ইভিএম সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ইভিএম কেনার চলমান এই প্রকল্প নেওয়ার আগে ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনের রাজ বাজেট থেকে প্রায় ৪৯ কোটি টাকা ব্যয় করে ২ হাজার ৫৩৫টি ইভিএম কেনা হয়েছিল। কিন্তু যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাত্র ৪ বছরে অকেজো হয়ে পড়ে এসব মেশিন।

ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিগত কমিশনের পরিকল্পনা ছিল দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের। ঐ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ধাপে ধাপে মোট ১ লাখ ৫৪ হাজার ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে কেনা হয়। প্রতিটি মেশিনের পেছনে ব্যয় হয় ২ লাখ ১০ হাজার টাকার মতো। যা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু এত দামি মেশিন কোথায় রাখা হবে, তার জন্য প্রকল্পে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে যথাযথ যত্ন ছাড়াই এগুলো স্থান পাচ্ছে মাঠ কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে। ইভিএমে মেশিন একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করতে হয়। বিদ্যমান স্টোররুমে এই ব্যবস্থার কতটা সুযোগ রয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিএমটিএফে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় মেশিনগুলো থাকলেও অন্য মেশিনগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই উপজেলাগুলোর নির্বাচন অফিসের আলো-বাতাসহীন বদ্ধ কক্ষে পড়ে থেকে অকেজো হয়ে পড়ছে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ৫ হাজারের মতো উন্নতমানের এই ইভিএম দিয়ে ভোট নেওয়া হয়। বর্তমানে প্রতিটি নির্বাচনেই কম-বেশি হারে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রথম দিকে ইভিএমগুলো আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের বেজমেন্টে রাখা হতো। কিন্তু সমস্যা হয় নির্বাচনের সময় মাঠ পর্যায়ে মেশিন পাঠানো নিয়ে। কেননা এতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। এরপর সিদ্ধান্ত হয় মাঠ কার্যালয়গুলোতে ইভিএম রাখার। কিন্তু কোনো মাঠ কার্যালয়ে ইভিএম রাখার মতো পর্যাপ্ত কক্ষ নেই। এছাড়া ইভিএম রাখার জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন, তা-ও নেই।

গত বছরের শেষের দিকে উপজেলা নির্বাচন অফিসে ইভিএম মেশিন উইপোকা, তেলাপোকায় নষ্ট করছে বলে খোদ ইসি কর্মকর্তারাই বৈঠকে জানান। এমন অভিযোগের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত রিপোর্টে জানা গেছে, বেশ কিছু কাগজের প্যাকেট নষ্ট হয়েছে। ইভিএম মেশিনের কোনো ক্ষতি হয়নি। এরপর স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার করা ইভিএমগুলো বর্তমানে মাঠ অফিস ছাড়াও দেশের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে রাখা হয়েছে। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে। মাঠ কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বারবার তাগাদা দিচ্ছে মেশিনগুলো সরিয়ে নেওয়ার। কিন্তু তাদের এসব মেশিন রাখার জায়গা নেই। এ অবস্থায় প্রথমে সিদ্ধান্ত হয় মাঠ কার্যালয়গুলোর পরিধি বাড়ানোর। কিন্তু গণপূর্ত বিভাগ জানিয়েছে আঞ্চলিক, জেলা বা উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়গুলোর যে নকশা, তাতে এগুলো ওপরের দিকে আর বাড়ানো যাবে না। এরপর সিদ্ধান্ত হয় ভবন ভাড়া নেওয়ার। কিন্তু সে সিদ্ধান্তেও কোনো কূল-কিনারা মিলছে না। দরপত্র আহ্বান করলেও সাড়া মেলেনি। কেননা ইভিএম রাখার জন্য প্রতি উপজেলায় ৫ হাজার বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু এই পরিমাণ জায়গা একই ভবনে মিলছে না। আর মিললেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো নয় বা ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ভাড়া পাওয়া গেলেও দেখা যাচ্ছে তা বাজেটের চেয়ে বেশি।

গত ৭ জুন ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভায় (পিআইসি) ইভিএম সংরক্ষণের বরাদ্দ এবং জনবল বাড়নোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বর্তমানে ইভিএম প্রকল্পে মাত্র ১৩ জন লোকবল বরাদ্দ। দেশব্যাপী ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচন করার জন্য এই জনবল নিতান্তই অপ্রতুল বলে সভায় উল্লেখ করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব আশোক কুমার দেবনাথ বলেন, যখন ইভিএম প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছিল, তখন সংরক্ষণের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। ঐ সময় কেন্দ্রীয়ভাবে ইভিএম সংরক্ষণের কথাই কেবল বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। এখন উপজেলা পর্যায়ে সংরক্ষণ করা হবে।

ইত্তেফাক/ইআ