দেশের প্লাস্টিক খেলনা শিল্প রপ্তানি খাত হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন বয়সের শিশুদের বিনোদনের জন্য খেলনা ব্যবহার করা হয়। দিন দিন বাড়ছে এর চাহিদা। বাংলাদেশের খেলনা ইতোমধ্যে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় পা রেখেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি বিদেশের বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদা বেশ ভালো। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্লাস্টিক খাতের রপ্তানি ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমানে এই সেক্টর থেকে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি ডলার। বর্তমানে দেশে ৫ হাজার ৩০টি প্লাস্টিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ৯৮ শতাংশ এসএমই প্রতিষ্ঠান। প্রায় ১৫ লাখ লোকবল এ খাতের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৯৮ সালে মাত্র সাতটি খেলনার মেধাস্বত্ব নিবন্ধন (পেটেন্ট) করা হয়। সেটা এখন মোট ২ হাজার ৫৫৮টি। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে দেশ থেকে মোট প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানির ২৯ শতাংশ আয়ই এসেছে খেলনা থেকে। এই সময়ে খেলনা রপ্তানিতে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২ শতাংশ। বাংলাদেশের প্লাস্টিক রপ্তানি মোটামুটি ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে রয়েছে।
করোনার মধ্যে গত ২০২০-২১ অর্থবছরেও প্লাস্টিক খাতের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশ। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খেলনা রপ্তানিতে বাংলাদেশের আয় ছিল মাত্র ১ কোটি ৫২ লাখ ডলার। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) খেলনা রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার, অর্থাৎ গত ছয় বছরে বিশ্ববাজারে খেলনা রপ্তানিতে বাংলাদেশের আয় প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ ৩১ দশমিক ৭৬ শতাংশ প্লাস্টিকের খেলনা রপ্তানি হয় স্পেনে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইতালি ও ফ্রান্স। এই দুই দেশে খেলনা রপ্তানির হিস্যা হচ্ছে যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ ও ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। বিল্ডের হিসাব অনুযায়ী প্লাস্টিকের খেলনা রপ্তানিতে ১৬ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি ধরে ২০৩০ সালে বাংলাদেশ তৈরি খেলনার রপ্তানি বাজার ১৫ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে।
সম্ভাবনাময় এ খাত আরো একটু সহযোগিতা পেলে দ্রুত এগিয়ে যাবে। প্লাস্টিক খাতের উপখাত খেলনায়ও বাংলাদেশ বেশ ভালো করছে। দেশে খেলনার ব্যবহার বেড়েছে। এখন প্রায় আমদানি করতে হয় না। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত খেলনা রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল। করোনাকালে রপ্তানির গতি একটু কমলেও এবার আবার ভালো করছে। দেশে প্লাস্টিকের খেলনার মতো নতুন নতুন রপ্তানি খাত তৈরি হচ্ছে। এটা আরো বাড়াতে হবে। তবে খেলনা পণ্যের মান বাড়ানোর পাশাপাশি দামও কমাতে হবে। উদ্যোক্তারা প্রতিটি খেলনায় ভিন্নতা ও নতুনত্ব নিয়ে আসায় অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি বিদেশের বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদা বেশ ভালো। বিপিজিএমইএ ডিপার্টমেন্ট অব পেটেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে নতুন খেলনা আইটেমের পেটেন্ট রেজিস্ট্রেশন নিয়ে থাকে। আজ থেকে প্রায় ২৪ বছর আগে ১৯৯৮ সাল থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে মাত্র সাতটি খেলনা পণ্য পেটেন্ট রেজিস্ট্রেশন করা হয়। হিসাব মতে —১৯৯৯ সালে ১৫৫টি, ২০০০ সালে ৫৯টি, ২০০১ সালে ১২২টি পেটেন্ট রেজিস্ট্রেশন হয়। তেমনি ২০১৮ সালে ২৯৭টি, ২০১৯ সালে ২৩৪টি, ২০২০ সালে ১০৯টি, ২০২১ সালে ১৫৫টি এবং ২০২২ সালে অদ্যাবধি ৭১টি অর্থাৎ সর্বমোট ২ হাজার ৫৫৮টি পেটেন্ট রেজিস্ট্রেশন হয়েছে।
খেলনা শিল্প বিকাশের জন্য সরকারের সব রকমের সহযোগিতা লাগবে। যেহেতু প্লাস্টিক খাত একটি শ্রম নির্ভর এবং প্রচুর পরিমাণে নারী শ্রমিকের কাজের সুযোগ আছে তাই এই সেক্টর একদিন গার্মেন্টসের মতো রপ্তানিতে বড় ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা আছে। এক দশক আগেও ৯০ শতাংশ খেলনা আমদানি নির্ভর ছিল। বর্তমানে ১০ শতাংশ আমদানি হয়, ৯০ শতাংশ দেশে তৈরি হয়। দেশের রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ ঝুড়িতে নতুন করে আশা দেখাচ্ছে প্লাস্টিকের খেলনা।
রাজধানীতে সবচেয়ে বড় এবং ব্যস্ততম খেলনার বাজার পুরান ঢাকার চকবাজারে। বেশ কয়েক বছর আগেও প্লাস্টিকের খেলনার প্রায় পুরোটাই আসত চীন ও তাইওয়ান থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে ভালো একটি জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশে তৈরি খেলনা সামগ্রী। দেশে বিভিন্ন ধরনের খেলনার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে এ শিল্পে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ। এক সময়ে বাংলাদেশে খেলনা সামগ্রী হিসেবে অনেক নিম্নমানের পণ্য তৈরি হতো। যা ক্রেতাদের তেমনভাবে আকৃষ্ট করতো না। ফলে বিদেশ থেকে খেলনা আমদানি করা হতো, যার বেশির ভাগই আমদানি হতো চীন থেকে। তবে বর্তমানে চীন থেকে আমদানিকৃত খেলনার সমমানের অনেক খেলনা আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে। দেশে উন্নত কারিগরি প্রযুক্তির অভাব থাকায় খেলনা শিল্প তেমন এগিয়ে যেতে পারছে না, বার বার হোঁচট খাচ্ছে। দেশীয় লেদ কারখানা থেকে ম্যানুয়ালি মোল্ড তৈরি করতে হচ্ছে। অথচ বিদেশে কম্পিউটারাইজড মেশিনে এ ধরনের মোল্ড তৈরি করা হয় অত্যন্ত নিখুঁত এবং সুন্দরভাবে।
আজকাল অনেক ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা চীন ও তাইওয়ান থেকে মোল্ড বা ডাইস করে নিয়ে আসছেন। ডাইস তৈরির কম্পিউটারাইজড মেশিন দেশে থাকলে বাংলাদেশেই অনেক সুন্দর, উন্নত এবং আধুনিক মানের খেলনা তৈরি সম্ভব। এতে করে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ভালো ভালো খেলনা সামগ্রী তৈরি করে বাজারে ছাড়া সম্ভব হবে। সুলভে ডাইস তৈরি করা গেলে চীনা বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে। তাছাড়া দক্ষ, আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন ডিজাইনারেরও অভাব রয়েছে এখানে। শুধু ডাইস দিয়ে খেলনা তৈরি করলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না, এর সঙ্গে আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন রয়েছে। এই শিল্প যদি দিনে দিনে উন্নতি লাভ করে তাহলে আরো অনেকেই আগ্রহী হবেন এ ব্যাপারে।
এ ব্যবসায় উদ্যোক্তা বাড়তে থাকলে শিল্পটি আপনা আপনি বেশ জমজমাট হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। খেলনা তৈরির কাজটি মূলত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন ব্যাংক এসএমই ঋণের আওতায় খেলনা তৈরির কাজে নিয়মিত উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে মূলধন যোগান দিতে পারে। কারণ অনেক উদ্যোক্তা পর্যাপ্ত পুঁজির অভাবে দারুণ সম্ভাবনাময় এই শিল্পটিকে এগিয়ে নিতে পারছেন না। পুঁজির যোগান পেলে খেলনা শিল্প চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে খুব দ্রুতই।