দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মূল্যবোধ চর্চার সূতিকাগার। যেখানে মুক্তবুদ্ধি চর্চার পাশাপাশি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এবং তা বাস্তবায়নের যথোপযুক্ত প্রজন্ম তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন লক্ষ্যচ্যুত হয়ে দিন দিন পরিণত হচ্ছে। অনিরাপদ ও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত, স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী, শ্রমিক দ্বারা হয়রানি, হামলা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসে ভয়শূন্য চলাচল প্রায় দুরূহ। অনেক ক্ষেত্রে নিজ ক্যাম্পাসেই নারী শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, কাউকে গেস্টরুম নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে, কখনো আবার ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরেই দুর্বৃত্তের অস্ত্রের আঘাতে শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতনের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা সাক্ষী হলাম আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে পাঁচ তরুণ সংঘবদ্ধ হয়ে ঐ শিক্ষার্থীকে যৌন হেনস্তা ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে। কি সাংঘাতিক! এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও শাটল ট্রেনে ছিনতাই, অপহরণ ও যৌন হয়রানি ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। গত ১৪ এপ্রিল রাতে শাটল ট্রেনের বগিতে এক নারী শিক্ষার্থী যৌন নির্যাতনের শিকার হন।
অরাজকতা যেন থামানোই যাচ্ছে না। চলমান শাটল ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে এক মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ জন শিক্ষার্থীকে আহত করা হয়। সিএনজি অটোরিকশা কিংবা বাস-রিকশা বেশি ভাড়া আদায়ের জেরে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিবাদের ঘটনা নতুন নয়— এই চিত্র দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। গত ২৫ জুলাই নিজ ক্যাম্পাসের ভেতরেই ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীকে। সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের ভেতরে অজ্ঞাত হামলাকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বুলবুল। বহিরাগত ও স্থানীয় সন্ত্রাসী কর্তৃক ন্যক্কারজনক হামলার সাক্ষী হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থী। অন্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাও ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। নিয়মিত শিক্ষার্থীরা গেস্টরুমে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনসহ নানা ধরনের অত্যাচার-অনাচারের শিকার হচ্ছেন— এ জাতীয় ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হচ্ছে বিদ্যার্থীরা জন্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞার একটি নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পরিবেশ নিশ্চিত করা, সেখানে শিক্ষার্থীরা কখনো সহপাঠী কখনো বহিরাগতদের দ্বারা লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হন। এভাবে চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। তাদের মেধা, অদম্য কর্মস্পৃহা, সততা, দেশপ্রেম একটি জাতির উন্নতির ধারাকে গতিশীল রাখে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহারলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘একটি দেশ ভালো হয় যদি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়’। একটা দেশকে সুস্থ ধারায় পরিচালনা করতে চাইলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হয়। আমরা দেখেছি, উন্নত বিশ্বের দেশগুলো দক্ষ ও মানসম্মত জনশক্তি তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে অধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটে উল্টো—দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন এক গভীর নিরাপত্তা-সংকটে পতিত! শিক্ষাজীবনের ১২টি সিঁড়ির সফল সমাপ্তির পর পুঞ্জীভূত স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষার্থীরা মুক্ত জ্ঞানচর্চার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম, অনিরাপত্তা, অব্যবস্থাপনায় তাদের স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায়—এটা মেনে নেওয়া কঠিন। এমতাবস্থায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতে দিতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। গবেষণা, জ্ঞানবিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার জন্য সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়