‘বিশ্ববিদ্যালয় হবে শহর থেকে দূরে, নির্জন, কোলাহলমুক্ত, মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে, যেখানে প্রকৃতির মধ্যে শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠবে, প্রকৃতিই হবে তাদের শিক্ষক।’ জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক রুশোর এই অভিব্যক্তির অপূর্ব নিদর্শন নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমিখ্যাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে প্রকৃতির কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আয়তনে দেশের সর্ববৃহতৎ ক্যাম্পাস।
১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর দেশের অন্যতম স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ধারাবাহিক অগ্রযাত্রায় বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৯০৬ জন শিক্ষক, ৯টি অনুষদের অধীনে ৪৮টি বিভাগ এবং ছয়টি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ২৭ হাজার ৮৩৯ জন শিক্ষার্থীকে নিয়মিত পাঠদান করে যাচ্ছে। দেশের অন্যতম প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কালের পরিক্রমায় এ বছর ৫৭তম বর্ষে পদার্পণ করতে যাচ্ছে।
সবুজ বৃক্ষরাজির ওপর উড়ন্ত বিচিত্র রঙের হরেক রকম পাখি, পাহাড়ের বুকে ঘুরে বেড়ানো মায়া হরিণ, বিশাল অজগর কিংবা বিচিত্র আর দুর্লভ প্রাণীর জীবন্ত জাদুঘর এই চবি ক্যাম্পাস। পাহাড়ের বুকচিরে বয়ে চলা ঝরনাধারা, দোল খাওয়া ঝুলন্ত সেতু, দুর্গম গিরিপথ আর হাজারো শিক্ষার্থীর কলকাকলিতে মুখরিত ক্যাম্পাস প্রকৃতি আর মানবপ্রমের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। চারদিকে পাহাড়ঘেরা ও সবুজের ফাঁকে ফাঁকে সুবিশাল ইমারতে সজ্জিত অনুষদ ভবন আর ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হলগুলো যোগ করেছে এক ভিন্ন আবহ। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রদের আটটি এবং ছাত্রীদের জন্য চারটি হল রয়েছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে একটি আবাসিক হোস্টেল। শহর থেকে শিক্ষার্থী পরিবহনের জন্য রয়েছে বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেন পরিষেবা, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা-সংস্কৃতি-আবেগ-অনুভূতি চর্চার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।
দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামেও রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অসামান্য অবদান। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনসহ প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যেই এই বিশ্ববিদ্যালয় আলোড়িত হয় বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের দ্বারা। মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে বীরত্বের কৃতিত্বস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেন ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দেশ পুনর্গঠন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ছাড়াও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ।
সৃজনশীল কল্পনাশক্তি এবং মননশীলতা প্রসারের মাধ্যমে জ্ঞান-গবেষণায় আদৃত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী জন। দেশবরেণ্য অসংখ্য শিক্ষক, গবেষক, শিল্পী-সাহিত্যিকের পদচারণায় সমৃদ্ধ হয়েছে চবি ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে অজস্র পদক অর্জনের অনন্য কৃতি। এছাড়া বর্তমান সময়ের জ্ঞান-গবেষণার নানা ক্ষেত্রে রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উল্লেখযোগ্য অবদান।
নিঝুমপুরীর জ্ঞানরাজ্যখ্যাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানি হিসেবে অনন্য। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণায় এই বিশ্ববিদ্যালয় এখনো পিছিয়ে রয়েছে অনেকখানি। তাই তো প্রতিষ্ঠার ৫৭তম বর্ষে এসেও প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলানোটাও জরুরি। বিশ্বের কোনো র্যাংকিংয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নাম নেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের; রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ। এখনো কাটেনি আবাসন সংকট। পুরোপুরি কাটেনি সেশনজট। প্রতিষ্ঠার এতদিনেও নির্মিত হয়নি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)। চলমান রয়েছে অ্যানালগ পদ্ধতির ব্যবহার, হিংসাত্মক ছাত্ররাজনীতি, খাবারের নিম্নমান, পরিবহনসংকট, সেকেলে পাঠসূচি অনুসরণ, বিদেশি শিক্ষার্থী আকর্ষণে অক্ষমতার সঙ্গে আরো আছে নিয়মিত সমাবর্তন না করার ব্যর্থতা। নানা সংকট ও নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ছাড়াছড়ি চবির যুগান্তকারী সব অর্জনকেও ম্লান করে দিচ্ছে।
বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রিয় বিদ্যাপীঠ ঘিরে প্রত্যাশার অন্ত নেই। জন্মদিনের শুভক্ষণে প্রাণের ক্যাম্পাসের প্রতি রইল অনিঃশেষ ভালোবাসা ও শুভকামনা। যুগ যুগ ধরে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ নৈসর্গিক অবস্থা বজায় রেখে, শতত বহমান থাকুক শিক্ষা-সংস্কৃতি-জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পচর্চার স্বর্গরাজ্য প্রাণের ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়