বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১
The Daily Ittefaq

বর্তমান সংকট রোগের উপসর্গ মাত্র: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

অর্থনীতির প্রধান খলনায়ক আর্থিক খাতের দুর্বলতা

আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২২, ০৬:৩০

অর্থনীতি নিয়ে বর্তমানে যে সংকট দেখা যাচ্ছে সেগুলো উপসর্গ মাত্র। এই অবস্হার জন্য আন্তর্জাতিক সংকটকে দায়ী করা হচ্ছে, অথচ এর মূল খলনায়ক হলো—অভ্যন্তরীণ আর্থিক খাতের দুর্বলতা। এবারের বাজেট উপস্হাপনে অর্থমন্ত্রী ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু গত দুই মাসে পরিস্হিতি আরো গুরুতর হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

গতকাল বৃহস্পতিবার সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো এসব কথা বলেন। অনলাইনে আয়োজিত এই আলাপচারিতার শিরোনাম ছিল ‘বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় একটি উত্তরণকালীন নীতি সমঝোতা খসড়া।’ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান সংকট রোগের উপসর্গ মাত্র। রোগ ভিন্ন জায়গায়। সেটি হলো সংস্কার না হওয়া। 

তিনি বলেন, আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায় সরকারকে ভতু‌র্কি কমাতে হচ্ছে। অথচ এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গরিব মানুষষে সুরক্ষা দিতে ভতু‌র্কি দেওয়া বেশি প্রয়োজন ছিল। আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায় দুই থেকে তিন বছরের জন্য একটি অন্তর্বর্র্তীকালীন অর্থনৈতিক নীতি সমঝোতা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এই নীতি সমঝোতায় সামষ্টিক অর্থনীতি স্হিতিশীল রাখা, উত্পাদন ও কর্মসংস্হান অব্যাহত রাখা এবং গরিব মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়গুলো থাকতে হবে। এই নীতি প্রণয়ন বিশ্বাসযোগ্য ঐকমত্যের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। তাহলে আগামীতে যদি রাজনৈতিক টানাপড়েন হয়, তখনো আর্থিক খাতকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।

এই সমঝোতার বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অর্থনীতির চলমান সংকট কীভাবে মোকাবিলায় করা যায়, বিষয়টি নিয়ে সরকার সংসদের ভেতরে এবং বাইরে আলোচনা করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। তিনি বলেন, কিছু নীতিনির্ধারক অপরিপক্ব ও বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলছেন। তারা বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলছেন। কেউ বলছেন, দুই মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ঠিক হয়ে যাবে, কেউ বলছেন, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেবে না। এসব কথা শুনে মনে হচ্ছে, নীতি প্রণয়নের মধ্যে রাজনীতিবিদেরা নেই, আমলানির্ভর নীতি প্রণয়ন হচ্ছে। 

তিনি আরো বলেন, আগের অর্থমন্ত্রীগণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মতামত শুনতেন। কিন্তু এখন এগুলো করা হচ্ছে না। সরকার যতই কাজ করুক না কেন, সেটা যদি বিশ্বাসযোগ্য না হয়, জনগণের আস্হা অর্জন না করে, তাহলে সবচেয়ে ভালো নীতিও তখন কাজে আসে না। সে জন্যই আমি বলছি সমঝোতার ভিত্তিতে নীতি প্রয়োজনের কথা।

অর্থনীতির অবস্হা ঠিক রাখতে সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো সঠিক মনে করেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, অবশ্যই এগুলো সঠিক এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কিন্তু উদ্যোগগুলো সঠিক সময়ে আসছে না। অনেক সিদ্ধান্ত দেরিতে এবং বিচ্ছিন্নভাবে আসছে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, যা করা হচ্ছে না।

সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, হঠাৎ করে এত বেশি মূল্যবৃদ্ধি একটা প্রতিক্রিয়া হবে। তিনি মনে করেন, শুধু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নয়, সুদের হার, বিনিময় হারের ক্ষেত্রেও এমনটি সত্য। উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে দরিদ্র সরকার গত ১০ বছরে নিজের আর্থিক সংস্হান নিশ্চিত করেনি, যার অনিবার্য পরিণতি ভোগ করছে দেশ। যে কারণেই অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলা হোক না কেন, ২০২৪ শেষ হওয়ার আগে এই দুর্যোগ কাটবে না বলে তিনি মনে করেন। 

ব্যাংকের সুদ হার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি রোধে সুদ হার বাড়তে হবে। তবে সুদ হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে ধাপে ধাপে করতে হবে।

আইএমএফের ঋণ পাওয়ার পূর্বশত হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে দেবপ্রিয় বলেন, কেউ যদি এটা বলেন, এর মানে, দেশ নীতি সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কোনো সরকারের জন্য এটি সম্মানজনক নয়। ভতু‌র্কি পুনর্মূল্যায়নের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সার, বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাসে ভতু‌র্কি দরকার। কিন্তু বিদু্যত্কেন্দ্রগুলোতে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে যে ভতু‌র্কি দেওয়া হচ্ছে সেটা খারাপ ভতু‌র্কি। 

বর্তমান সংকটে শ্রমিক শ্রেণিকে সুরক্ষা দিতে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে একটি জাতীয় মজুরি কমিশন গঠনের সময় হয়ে গেছে। তৈরি পোশাকশ্রমিকদের এখন মহার্ঘ ভাতা দেওয়া উচিত। ডলারের বেশি বিনিময় হারের সুবিধা পাচ্ছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। তাই এর একটি অংশ পোশাকশ্রমিকদের পাওয়া উচিত। কারণ বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকশ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি