শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অনুব্রত মন্ডলের উত্থানের চমকপ্রদ কাহিনি

আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২২, ১৭:১০

অনুব্রত মন্ডল বা কেষ্ট ছিলেন সামান্য একজন মাছ ব্যবসায়ী। সেখান থেকে বীরভূমে তৃণমূলের সর্বেসর্বা। অভিযোগ, তার ভয়ে কাঁপত মানুষ থেকে প্রশাসন। 

অনুব্রতর পৈত্রিক বাড়ি বীরভূমের নানুরে হাট সেরান্দি গ্রামে। তার বাবার ছিল ছোট একটা মণিহারি দোকান। তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজো হলেন অনুব্রত। পড়েছেন ক্লাস এইট বা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে বাবার দোকানে বসতেন অনুব্রত। তারপর তিনি মাছের ব্যবসা শুরু করেন। নিজের স্বাধীন ব্যবসা। সেখান থেকে অনুব্রতর উত্থানের শুরু। কারণ, মাছের ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যোগ দিলেন রাজনীতিতে। প্রথমে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন কংগ্রেসে ছিলেন। যুব কংগ্রেস সভাপতি। আর অনুব্রতও যুব কংগ্রেস কর্মী। প্রথম থেকেই দাপুটে নেতা। হাঁকডাক করতে পারেন। কাজে ক্লান্তি নেই। ফলে নেত্রীর চোখে পড়ে গেলেন। পরে ১৯৯৮ সালে যখন কংগ্রেস ছেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করলেন, তখন তার পছন্দের কেষ্টও তৃণমূলে যোগ দিলেন। শুধু যোগ দেয়াই নয়, বীরভূমের যুব তৃণমূল সভাপতিও হলেন। তৃণমূলের জেলা সভাপতি তখন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। পেশায় চিকিৎসক এবং জেলার অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অনুব্রতর সঙ্গে বিরোধের জেরে তৃণমূল ছেড়ে দেন সুশোভন। অনুব্রতকে তখন জেলা সভাপতির পদে বসালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। তখন থেকেই অনুব্রত জেলায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। পঞ্চেয়েত থেকে শুরু করে লোকসভা পর্যন্ত, তার সঙ্গে কথা না বলে কোনো প্রার্থী ঠিক হতো না। অনুব্রত নিজে কখনো ভোটে লড়েননি। তবে বীরভূমে দলের প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতেন তিনি। 

কেন ভোটে লড়েননি?

এই প্রশ্নের জবাবে অনুব্রত বলেছেন, ''প্রার্থী হয়ে তো কোনো লাভ নেই। এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাই প্রার্থী। তিনি আমার সঙ্গে আছেন। সেখানে কেন হঠাৎ প্রার্থী হতে যাব?''

তবে প্রার্থী না হলে কী হবে, তিনি ছিলেন বীরভূমের একচ্ছত্র নেতা। বিরোধীদের অভিযোগ, তৃণমূল তো বটেই, তার কথায় প্রশাসন চলত। পদে না থেকেও পুরো ক্ষমতাভোগ করতেন তিনি।

অনুব্রতর সম্পত্তি

গরুপাচারকাণ্ডে সিবিআই অনুব্রতকে গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে কয়লা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগও আছে। সিবিআই সম্প্রতি অনুব্রতর সম্পত্তির হিসাব চেয়েছিল। অনুব্রত তার বিশদ বিবরণ সিবিআইয়ের কাছে দিয়েছেন।  উত্তরবঙ্গ সংবাদ জানাচ্ছে, আদালতে সিবিআই অনুব্রতর মোট ৪৫টি সম্পত্তির দলিল দিয়েছে।

সিবিআই আদালতে অনুব্রতর দেহরক্ষী ও গরুপাচার মামলায় ধৃত সায়গল হোসেনের সম্পত্তির হিসাবও দিয়েছে। এবিপি আনন্দ জানাচ্ছে, সায়গল হোসেনেরই একশ কোটি টাকার বেশি সম্পত্তির হিসাব পেয়েছে সিবিআই। তার মধ্যে চারটি ফ্ল্যাট ও পাঁচটি বাড়ি আছে। গাড়ি, ট্রেলার, ক্র্যাশার সহ ১০টি গাড়ি আছে। আছে দুইটি পেট্রোল পাম্প। নিউটাউনে তার দুইটি নির্মীয়মান বাড়ি আছে বলেও সিবিআই দাবি করছে। 

এছাড়াও প্রচুর কৃষিজমি ও কয়েকশ গ্রাম গয়না আছে তার।

বিরোধীদের অভিযোগ, দেহরক্ষীর কাছেই যখন বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি আছে, তখন অনুব্রতের কাছে আরো বিশাল সম্পত্তি থাকবে তা অনুমান করা যায়। রাজ্যের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ''একসময় যিনি মাছ বিক্রি করতেন, তিনি আজ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক।''

অনুব্রতর ভোটকৌশল

২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটের আগে অনুব্রত মন্ডল বলেছিলেন, ''পুলিশের গাড়িতে বোমা মারুন।'' পাড়ুইয়ের ওই সভাতে অনুব্রত বলেছিলেন, ''নির্দল প্রার্থীর বাড়ি জ্বালিয়ে দিন।''

একই বছরে তিনি কংগ্রেস কর্মীদের 'কবজি কেটে নেব' বলে হুমকি দেন। আবার মঙ্গলকোটে ২০১৪-র লোকসভায় বিরোধীদের 'ইঁদুরের বাচ্চা' বলে তাদের বিষ দিয়ে মারার কথা বলেছিলেন। সেই অনুব্রতই আউশগ্রামে গিয়ে সিপিএম কর্মীদের বলেন, ''চোখ তুলে নেব''। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি বলেন, ''বিরোধীদের জন্য চড়াম চড়াম ঢাক বাজবে।'' সেই সময় তিনি বিরোধীদের জন্য বুথে বুথে 'গুড়-বাতাসা' থাকবে বলেও হুমকি দেন।

২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে  তিনি বলেন, ''রাস্তায় বেরোলে দেখবেন, গলির মোড়ে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে।'' এরপর ৪২টি জেলা পরিষদের মধ্যে ৪১টিতেই প্রার্থী দিতে পারেনি বিরোধীরা।  শঙ্খ ঘোষ তখন লিখেছিলেন, ''দেখ্ খুলে তোর তিন নয়ন/রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে/দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।''

২০২১ সালে আউশগ্রামে তৃণমূল কর্মী খুন হওয়ার পর অনুব্রত বলেন, ''১৫ দিনের মধ্যে খুনি ধরা না পড়লে ভয়ঙ্কর খেলা খেলে দিয়ে যাব।'' এটাও বলেছিলেন, ''পুলিশ না ধরলে বলুক কে খুন করেছে, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে নির্বংশ করব। আমার দলের লোক হলে খোলা রাস্তায় গুলি করব।''

এভাবেই একের পর এক বিতর্কিত কথা বলে গেছেন অনুব্রত। তাকে কেউ থামায়নি। কোনো মামলা হয়নি। অবশেষে গরুপাচারকাণ্ডে তাকে গ্রেপ্তার করলো সিবিআই। 

ইত্তেফাক/এসআর