বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নিজেকে ভালোবাসতে হবে 

আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০২২, ০৪:৪৭

আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় ‘জীবনে কোনোদিন এমন অবস্থায় পড়েছেন যে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়েছে? জীবনকে তুচ্ছ মনে হয়েছে? ইচ্ছে করেছে মুহূর্তেই নিজেকে শেষ করে দিতে?’ নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তরে অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষের উত্তর হবে ‘হ্যাঁ’। ইতিমধ্যে অনেকে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্বিষহ ও কঠিন মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণ করছেন নিশ্চয়।

যা হোক গবেষণা বলছে, আত্মহত্যা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা! যেখানে মানুষ বাঁচার জন্য সবকিছু করতে চায়, অর্জিত সম্পদ বিলীন করতে কুণ্ঠাবোধ করে না; সেখানে নিজেকে নিজে শেষ করে দেওয়ার পরিস্থিতি!, ভাবলেই শিহরিত হতে হয়। সেলফ হার্ম টেন্ডেন্সি বা নিজের ক্ষতি করার মানসিকতাকে আমরা সাদামাটাভাবে আত্মহত্যা বললেও নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা আর আত্মহত্যার মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। যা হোক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা রাতারাতি তৈরি হয় না। এটি অনেক দিন ধরেই মানুষের ভেতরে থাকে। বারবার নানা ব্যর্থতায় নিজেকে মেরে ফেলতে চাওয়া মানুষ একসময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তা-ই করে বসে থাকে।

তরুণ-বৃদ্ধ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গরিব-বিত্তবান কেউ যেন পিছিয়ে নেয়। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গত বছর ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ শুধু ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করেন। দৈনিক আত্মহত্যা করেন ২ হাজার ১৯১ জন!

এই যে আত্মহত্যার সমীকরণ আমরা সহজে মিলিয়ে নিচ্ছি, তার পেছনে মোটাদাগে কিছু বিষয় ভূমিকা রাখে। বৈশ্বিক পরিবর্তন, সোশ্যাল মিডিয়ার নানান রকম কনটেন্ট, প্রযুক্তির প্রভাব ইত্যাদি দৈনন্দিন আচার-আচরণকে প্রভাবিত করছে, ধৈর্য শক্তি কমিয়ে দিচ্ছে, অস্থির করে তুলছে।

এছাড়াও, মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজরদারি নাই যেটি আত্মহত্যা প্রতিরোধে বেশ সহায়ক। মূলত, এক জন মানুষ যখন পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব থেকে আলাদা থাকে তখন নানান দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। অস্থির হয়ে ওঠে। জীবনের মূল্য, সমাজে তার প্রয়োজনীয়তা ও দায়বদ্ধতার কথা ভুলে যায়। একাকিত্ব গ্রাস করে বসে। ফলে নিজেকে শেষ করে দিয়ে মুক্তি পাওয়ার বাসনা ওত পেতে থাকে। এছাড়া, আরো কিছু বিষয় আত্মহত্যার ঝোঁককে ত্বরান্বিত করে। যেমন, সম্পর্কের টানাপড়েন, পারিবারিক কলহ, পড়ালেখার চাপ, আর্থিক অনটন, মাদকাসক্তি, জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেলা, পরীক্ষায় অকৃতকার্য, বন্ধুবান্ধবের হাসিঠাট্টা বা হেয়প্রতিপন্নমূলক আচরণ, পরিবারের প্রত্যাশা মেটাতে না পারা ইত্যাদি কারণেও অনেকে আত্মবিধ্বংসী এসব সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে না।

পৃথিবী এখন যেভাবে এগিয়ে চলছে, এই যে আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলছি, নগরায়ণের কথা বলছি—এসবও কম দায়ী নয়। এই দ্রুত ‘ট্রান্সফরমেশন বা অবস্থার পরিবর্তন’-এর সঙ্গে খাপ খেতে না পেরেও অনেকে আত্মহত্যার কথা ভাবতে শুরু করে। গবেষণায় উঠে আসছে, শুধু বাংলাদেশে নয় বরং বিশ্বের বিভিন্ন নগরগুলোতে তুলনামূলক আত্মহত্যার হার বেশি। এই আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান লাগাম টেনে ধরা খুবই প্রয়োজন। সামাজিক যে পরিবর্তন, প্রয়োজনের তাগিদে ছেলেমেয়েকে পরিবার থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে; নিঃসঙ্গতা তৈরি হচ্ছে, এগুলোকে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এর জন্য সোশ্যাল স্কিল, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদির প্রতি জোরদার করতে হবে। মানুষ যেন কোনোভাবেই নিজেকে সমাজবিচ্যুত না ভাবে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ভুল করলে, দোষ করলে প্রচলিত একটা ‘টার্মিনোলজি’ প্রায় শুনে থাকি, ‘সমাজে মুখ দেখাব কী করে’—এ রকম ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এছাড়া একটি জাতীয় হটলাইন নম্বর চালু করা খুব দরকার। মানুষ যখন কোনো সিদ্ধান্তহীনতা বা হতাশায় ভুগবে তখন সহজেই যেন কোনো মানসিক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে পারে, মন খুলে সমস্যার কথা জানাতে পারে। নানা রকম উদ্যোগের পাশাপাশি, পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি নিজের গুরুত্বের কথা স্মরণ করা; আত্মহত্যার বিভিন্ন খারাপ দিক তুলে ধরা, প্ররোচিত হয় এমন বিষয় চিহ্নিতকরণ ও দূরীকরণ, মূল্যবোধ বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নজরদারি, সমস্যা সমাধানে কর্মশালা, এফজিডি ইত্যাদি উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্হাগুলোকে সমন্বয় করে কাজ করা দরকার। তবেই হয়তো আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে। সর্বোপরি, নিজের জীবনকে ভালোবাসতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন