শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ডিএমপির ওসিদের এত ক্ষমতার উৎস কী?

আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২২, ০০:০৮

গত এক যুগ ধরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) থানার ওসির দায়িত্ব পালন করছেন ঘুরেফিরে কয়েকটি মুখ। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের রাজধানীর এক থানা থেকে অন্য থানায় বদলি করা হয়। কিন্তু কখনই রাজধানীর বাইরে তাদের যেতে হয় না। এই ওসিরাই এখন মহাক্ষমতাধর। বলা হচ্ছে, ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশনাও মানেন না এসব ওসি। তারা রাজনৈতিক নেতাদের মতো আচরণ শুরু করেছেন। ওসিদের এই ক্ষমতার উৎস কী? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক তদবিরে তারা পদায়ন হয়ে থাকেন। সেখানে চলে অর্থের লেনদেন। যিনি অর্থ দিয়ে পোস্টিং নেন, তিনি তো ঊর্ধ্বতনদের মানবেন না, এটাই তো স্বাভাবিক।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘রাজধানীর ওসিদের একটা বড় সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এখন কোনো কর্মকর্তা যদি এই সিন্ডিকেট ভাঙতে যান তাহলে তিনিই বিপদে পড়তে পারেন। ফলে অঘোষিত এক রীতি হয়ে গেছে। তাদের রাজধানীর বাইরে পাঠানোর কথা এখন চিন্তা করাও কঠিন। তবে সবাই যে একই রকম এমন নয়, ৫০টি থানার মধ্যে দু-এক জন ভালো অফিসারও আছেন।’

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, রাজনৈতিক ক্ষমতাধর নেতাদের ধরে রাজধানীর থানাগুলোতে পোস্টিং নেন ওসিরা। ফলে পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকে না তাদের ওপর। পাশাপাশি এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ থানায় পোস্টিং নিতে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত লাগে। অধিকাংশ এলাকায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন ওসিরা। ফলে ঊর্ধ্বতনদের চেয়ে নেতাদের গুরুত্ব তাদের কাছে বেশি।

এই চিত্র যে শুধু বর্তমান সরকারের আমলে তা নয়। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও দেখা গেছে একই চিত্র। তখন রমনা থানার ওসি ছিলেন মাহবুবুর রহমান। তিনি এতটাই ক্ষমতাধর ছিলেন যে, পুলিশ কমিশনারের নির্দেশনাও শুনতেন না। তিনি হুমায়ুন আজাদ হত্যাচেষ্টার মামলায় আব্বাসকে গ্রেফতার করে ভয়াবহ নির্যাতন করেন। তাকে বোমা আব্বাস উপাধিও দিয়েছিলেন এই ক্ষমতাধর ওসি। খিলগাঁও থানাসহ বেশ কয়েকটি থানায় টাকার বিনিময়ে ধরে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনার খবরও তখন আলোচিত হয়।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ ইত্তেফাককে বলেন, ‘এখন অনেকেই মাতব্বর হয়ে গেছেন। পুলিশ একটি শৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের সব কাজ হবে শৃঙ্খলার মধ্যে, থাকবে জবাবদিহিতা। তাদের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, অপরাধ দমন করা। এই কাজগুলো মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে হচ্ছে কি না সেটা দেখভাল করার জন্য ডিআইজি, এডিশনাল ডিআইজি, এসপি, অতিরিক্ত এসপিরা আছেন। সঠিক তদারকি না করলে বিশৃঙ্খলা তো হবেই। সিনিয়ররা হয়তো ঠিকমতো মনিটরিং করছেন না। ঠিকমতো মনিটরিং করলে অনিয়ম দুর্নীতি তো থাকার কথা নয়। সবাই নেতা হয়ে গেলে তো হবে না। রাজনীতিবিদরা থাকবেন, তারা সুপারিশ করবেন, সেটা আইনসংগত হলে শুনবেন। কোনো সরকারি কর্মচারীর রাজনৈতিক আচরণ করা উচিত নয়। আমার মনে হচ্ছে এখন তদারকিতে কোথাও ঘাটতি আছে।’

একই ধরনের অভিমত পুলিশের সাবেক আরেক মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকারেরও। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, ‘থানায় তো নির্যাতন করার কথা নয়। কাউকে ধরলে তদন্ত করে দেখতে হবে, যাকে ধরা হয়েছে তিনি অপরাধী কিনা? পুলিশ প্রশাসনের অন্যতম কাজ হলো জবাবদিহিতা। পুলিশের কাজ হচ্ছে তদারকি সংস্থার মতো। ওসির ওপরে তো বহু অফিসার আছেন, তারা এটা দেখবেন। কাজের মধ্যে দু-একটি ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু পুলিশ হেফাজতে কারো মৃত্যু হলে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। পাশাপাশি নিরপেক্ষ তদন্ত করে জনগণকে জানাতে হবে। কারো গাফিলতি পাওয়া গেলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হকও মনে করেন, তদারকিতে ঘাটতি আছে। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, এখন তদারকিতে শিথিলতা এসেছে। বরগুনায় যেটা ঘটেছে সেটা ভয়াবহভাবে অপেশাদারিত্ব। নড়াইলে যেটা হয়েছে সেখানেও পেশাদারিত্ব দেখানো হয়নি। হাতিরঝিলের বিষয়টাও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। আমার মনে হচ্ছে, তদারকি শিথিল হয়ে গেছে। এসব ঘটনায় মানুষের মধ্যে পুলিশ নিয়ে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে। কতিপয় অপেশাদার সদস্যের কাজের জন্য গোটা বাহিনী প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে না? তবে সব সময় ওপর থেকে নিচ পর্যায় পর্যন্ত জবাবদিহিতার মধ্যে থাকতে হবে। কেউ না শুনলে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

ইত্তেফাক/ইআ