বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চিকিৎসাকেন্দ্র নয়, যেন মানুষ মারার ব্যবস্থা

আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০২২, ১০:১২

দেশের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশের লাইসেন্স আছে। বাকি ৯৪ শতাংশই অবৈধ। এসব অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোকে কোনোভাবেই চিকিৎসাকেন্দ্র বলা যায় না; বলা যেতে পারে মানুষ মারার ব্যবস্থাকেন্দ্র। সেখানে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলছে কথিত চিকিৎসাসেবা। নেই সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী অবকাঠামো। এক্সরে মেশিন এমন জায়গায় রাখা হয়, থাকে না ন্যূনতম সুরক্ষা ব্যবস্থা। এতে এক্সরে করতে আসা রোগী, যিনি এক্সরে করাচ্ছেন তিনি এবং আশাপাশের মানুষ ভয়াবহ রেডিয়েশনের শিকার হচ্ছেন। রি-এজেন্টের পাশে রাখা হচ্ছে তরকারি। ভুয়া চিকিৎসক, অনভিজ্ঞ নার্স ও অদক্ষ আয়া দিয়ে চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। অর্থাৎ চিকিৎসার নামে মরণব্যবস্থা চালু আছে।

অভিযানের দ্বিতীয় দিন গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ও রায়েরবাজার এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিম অভিযান চালিয়ে এমন চিত্র দেখতে পায়। এ কারণে গতকাল সাতটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৯-৩০ আগস্ট সারাদেশে চলমান অভিযানে রাজধানীতে ৭টিসহ মোট ৫২৪টি অবৈধ ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক বন্ধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগে এসব প্রতিষ্ঠানকে ৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

সারাদেশের বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে খুলনা বিভাগে রয়েছে সর্বোচ্চ ১৪৯টি, ঢাকা বিভাগে ১৪৫টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৬টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৪টি, রাজশাহী বিভাগে ৫৩টি, রংপুর বিভাগে ১৯টি, ঢাকা মহানগরে ১৫টি এবং বরিশাল বিভাগে ১২টি। আর সর্বনিম্ন একটি হাসপাতাল বন্ধ করা হয়েছে সিলেট বিভাগে।

জরিমানা প্রাপ্তির তালিকায় শীর্ষে রাজশাহী বিভাগ, সর্বোচ্চ ৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে এই বিভাগ থেকে। এছাড়া ঢাকা বিভাগে এক লাখ, খুলনা বিভাগে ৮০ হাজার এবং বরিশাল বিভাগে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ২০ হাজার টাকা।

এলাকাবাসী এই অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, মানুষ মারার চিকিৎসাকেন্দ্রের দরকার নেই। এসব অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক যেন আর চালু হতে না পারে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এবং ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও জেলা শহরে এই ধরনের জেনারেল হাসপাতাল রয়েছে। এছাড়া কিডনি ইনস্টিটিউট, মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পঙ্গু হাসপাতাল, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট, ইএনটি ইনস্টিটিউট, বক্ষ্যব্যাধি ইনস্টিটিউট, ক্যানসার ইনস্টিটিউট এবং শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের মতো আন্তর্জাতিক মানের সাব স্পেশালাইজড প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও এই ধরনের প্রত্যেকটি সাব স্পেশালাইজড ইউনিট রয়েছে। এছাড়া ঢাকা শহরে নামিদামি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বেশ কয়েকটি রয়েছে। ঢাকার বাইরেও রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এর পরও কোনো ধরনের অবকাঠামো ছাড়াই চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান কীভাবে সারা দেশে গড়ে ওঠে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিচালক, সিভিল সার্জন, স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনের একশ্রেণির ডাক্তার-কর্মচারী অবৈধ ক্লিনিক ব্যবসা জিইয়ে রাখার জন্য দায়ী। প্রতিদিন কত মানুষের প্রাণহানি ও অঙ্গহানির ঘটনা ঘটছে তার হিসাব নেই। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে।

দেশের আনাচেকানাচে গজিয়ে উঠেছে হাজার হাজার অনিবন্ধিত ক্লিনিক-হাসপাতাল। ফলে অধিকাংশ হাসপাতালে প্রতিদিনই ঘটছে নানা অঘটন। ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে রোগীদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে প্রায়ই। অনেক প্রতিষ্ঠানের তথ্যও নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। তবে তারা জানিয়েছে, দেশজুড়ে হাজার হাজার অবৈধ-নিবন্ধনহীন হাসপাতাল রয়েছে। যেগুলোর বেশির ভাগেরই নাম ও অবস্থান জানে না অধিদপ্তর। অভিযোগ রয়েছে অনলাইনে আবেদনের পর স্বাস্থ্য বিভাগের একটি টোকেন, সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছেন ক্লিনিক মালিকরা। এসব অবৈধ-নিবন্ধনহীন ক্লিনিক-হাসপাতাল বন্ধে নানা সময়ে অভিযান পরিচালিত হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ফলে ক্লিনিক-হাসপাতালগুলোর দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। দীর্ঘদিন মানহীন এসব ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসার নামে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। রমরমা বাণিজ্যের ফাঁদে পড়ে পরীক্ষার নামে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এমনকি ভুল রিপোর্ট ও চিকিৎসায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অনেককে। অনেক রোগীর জীবনও চলে যাচ্ছে ভুল চিকিৎসায়।

রাজধানীর রায়েরবাজারে বাংলাদেশ আই ট্রাস্ট কেয়ার হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ ছিল ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এরপর আর নবায়ন করা হয়নি। গতকাল এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কামরাঙ্গীরচরে নূর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নেই। আবার ছয় মাস পর নাম পরিবর্তন করে ফেমাস রাখা হয়। এখানে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে। রি-এজেন্টের পাশেই তরি-তরকারি রাখা হয়েছে। আলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও রি-এজেন্ট একই জায়গায় রাখা হয়েছে। এক্সরে মেশিন রাখার নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকতে হয়। কিন্তু সেখানে সেই ব্যবস্থা নেই। এতে এক্সরে করতে আসা রোগী, যিনি এক্সরে করাচ্ছেন তিনি এবং আশপাশের মানুষ রেডিয়েশনে আক্রান্ত হচ্ছে। লাইসেন্সের মেয়াদ আগেই শেষ হয়েছে। ঠিকানাও সঠিক নয়। এ দুটিও সিলগালা করা হয়েছে। একই এলাকায় ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার অভিযানের খবর পেয়ে পালিয়ে গেছে লোকজন। কামরাঙ্গীরচর ইউনিয়ন মেডিক্যাল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্সে আছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। তাদের ব্লাড ব্যাংক আছে। তবে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী করা হয়নি। এ কারণে ২০০২ সালের আইন অনুযায়ী ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কামরাঙ্গীরচরে ইনান ডায়াগনস্টিক সেন্টার, খিলগাঁওয়ে সীমান্তিক ক্লিনিক ও খিলগাঁওয়ের চৌধুরীপাড়া এলাকায় মুক্তি নার্সিং হোম সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।

  • বরিশালে তিন ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা

বরিশাল অফিস জানায়, বরিশালে অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হুমায়ুন শাহীন খানের নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালিত হয়। প্রথম দিনে নগরীর বান্দরোডস্থ শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে চারটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কাগজপত্রবিহীন দুটি সিটি স্ক্যান সেন্টারসহ তিনটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করে দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানকে অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। তবে বন্ধ করে দেওয়া তিনটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকেও ৫ হাজার টাকা করে সর্বমোট ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান। বন্ধ করে দেওয়া অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো হলো রয়েল সিটি সেন্টার, বরিশাল সিটি সেন্টার এবং সাইন্স ল্যাব। এছাড়া জরিমানা দেওয়া অন্য প্রতিষ্ঠানের নাম সুলতানা ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

  • জয়পুরহাটে কনসালটেশন সেন্টারের ফ্রিজে ইলিশ মাছ

জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করা, লাইসেন্সের মেয়াদ না থাকা, মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ও টেকনিশিয়ানদের কোনো নিয়োগপত্র না থাকায় জেলা আধুনিক হাসপাতাল মোড়ে অবস্থিত আনার কলি ল্যাব অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার সিলগালা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় আনার কলি ল্যাব অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারের ফ্রিজে ইলিশ মাছ পাওয়া গেছে। এছাড়া চারটি প্রতিষ্ঠানকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক কুমার কুণ্ডু গতকাল শহরের পাঁচটি ক্লিনিক ও হাসপাতালে অভিযান চালান।

  • খুলনার ২২ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান

খুলনা অফিস জানায়, খুলনার ২২টি অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ সময় লাইসেন্স ও আবেদন না থাকায় নগরীর চারটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের চিঠি দেয় খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এছাড়া খুলনা সিভিল সার্জন দপ্তর থেকে ৯ উপজেলার ১৮টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বৈধ কাগজপত্র নিয়ে দেখা করার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত সোমবার থেকে এ অভিযান শুরু হয়েছে।

  • চুয়াডাঙ্গায় দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগের অভিযানে লাইসেন্স ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ না থাকায় দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আদালতের বিচারক চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাজহারুল ইসলাম এ আদেশ প্রদান করেন। মঙ্গলবার সদর হাসপাতাল সড়কের বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এ অভিযান চালানো হয়।

  • রায়পুরে দুটি হাসপাতালে অভিযান

রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) সংবাদদাতা জানান, রায়পুর শহরের ম্যাক্স কেয়ার অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও নিরাময় হাসপাতালে ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গতকাল অভিযান চালিয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। এ সময় ম্যাক্স কেয়ার হাসপাতাল কার্যক্রম বন্ধ ও নিরাময়ের এক্সরে কক্ষ ১০ ইঞ্চি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

  • খানসামায় অভিযান

খানসামা (দিনাজপুর) সংবাদদাতা জানান, দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার পাকেরহাটে অবস্থিত প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মঙ্গলবার অভিযান চালিয়েছে উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ। অভিযানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি না থাকায় লাইফ কেয়ার ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অন্য ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিককে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও সেবার মান ঠিক করতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

ইত্তেফাক/ইআ