বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতিতেও দেশের বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো দেশে বিনিয়োগ চাহিদা তৈরি হচ্ছে। উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। অর্থাৎ অর্থনীতি গতিশীল হচ্ছে। যার কারণে বাড়ছে অর্থনীতির এই সূচক। দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে মনে করা হয় বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহকে।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিনিয়োগের মন্দায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের চিত্রও ছিল হতাশাজনক। ২০২০ সালে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকেই প্রতি মাসেই কমতে থাকে প্রবৃদ্ধি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুলাই শেষে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৮৭ হাজার ১১ কোটি টাকা। এ হিসাবেই ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
ঘোষিত মুদ্রানীতিতে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি ধরা রয়েছে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। মুদ্রানীতির ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা এরই মধ্যে ছাড়িয়ে গেছে। গ্রাহকেরা বেশি ঋণ নিচ্ছেন কারণ, ঋণের সুদহার এখনো ৯ শতাংশের মধ্যে আছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, বেসরকারিভাবে ঋণ বেড়ে যাওয়া অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক খবর। গত জুন থেকেই ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। আমদানি এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের ঋণ বেশি নিতে হয়েছে। অর্থাৎ আমদানি ব্যয় বাড়ার জন্য ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেশি বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি। তবে সামনের দিকে এ ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান এ অর্থনীতিবিদ বলেন, নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামালসহ এ খাতের সব আমদানি বেড়েছিল। সে কারণেই বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে। নানা পদক্ষেপের কারণে এখন আমদানি ব্যয় কমে আসছে।
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং করোনাকে সঙ্গে নিয়েই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের অর্থনীতি। আমদানি-রপ্তানি বাড়ছে। রাজস্ব আদায়েও গতি এসেছে। কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্স কমলেও এখন আবার গতি ফিরেছে। গত কয়েক মাস ধরে পণ্য আমদানি যেটা বাড়ছে তার প্রভাব বিনিয়োগে পড়তে শুরু করেছে। অর্থনীতি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। উদ্যোক্তারা নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে বিনিয়োগ করছেন। এসব কিছুর প্রভাবই পড়েছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে।
ব্যাংকাররা বলছেন, চলতি বছর থেকে এমনিতেই ঋণের চাপ বেড়েছে। কারণ, ঋণের সুদহার ৯ শতাংশের মধ্যে আছে। এ জন্য অনেকেই নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ উত্পাদনক্ষমতা বাড়াচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, প্রথমত পণ্যমূল্য বেড়েছে। এলসি ভ্যালু বেড়েছে। অনেক ‘বিলম্বিত ঋণপত্রের বা ডেফার্ড এলসি ঋণ এখন সমন্বয় হচ্ছে। আবার ডলারের দামও বেড়ে গেছে। ঠিক এই মুহূর্তে ব্যবসায়ীরা বিদেশি ঋণ নিতে চাচ্ছেন না। তারা লোকাল কারেন্সিতে লোন নিচ্ছেন। আবার ফরেন কারেন্সি লোনের সুদহার বেড়ে গেছে। টাকার অবমূল্যায়ন যেভাবে হচ্ছে তারা ভয়ে আছেন বিষয়টি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। অনেক কোম্পানির টাকার অবমূল্যায়নের জন্য লোনের সাইজ বেড়ে গেছে। এসব কারণে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়া মানে হচ্ছে অর্থনীতিতে কর্মযোগ্য বাড়া। কিছু মানুষের হাতে টাকা পয়সা কমে গেছে। অর্থনীতি সচল হলে মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। মানুষের হাতে টাকা পয়সা আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণ ছিল ১০ লাখ ২ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালের জুলাইয়ে বেড়ে হয় ১০ লাখ ৯৫ হাজার ২০১ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ঋণ বেড়ে হয় ১১ লাখ ৮৭ হাজার ১০ কোটি টাকা। আর গত জুলাইয়ে ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে পরের এক বছরে ঋণ বাড়ে ৯২ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুলাই থেকে পরের এক বছর ঋণ বাড়ে ৯১ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। আর গত এক বছরে ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা।
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে কম সুদে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ঋণের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়, যা এখনো বহাল আছে। এর ফলেও ঋণে বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আবার বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করছেন।