বৃহস্পতিবার, ০৮ জুন ২০২৩, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে 

আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৭:৪১

‘বাজারেতো এখন ট্রেড ভালোই হচ্ছে, ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে’। অফিসের সিনিয়র কলিগ রফিক সাহেব বললেন, ‘এখনই সময় শেয়ারে ইনভেস্ট করার’। কথাটি শোনার পর আমিন সাহেব কী করবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না। কারণ, রফিক সাহেব অনেক সিনিয়র কলিগ, তাকে না-ও বলতে পারছেন না। আবার আমিন সাহেবের নিজেরও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার ইচ্ছে আছে। কিন্তু তিনি এ বাজারের ‘অ আ’ কিছুই জানেন না!

দেশের শেয়ারবাজারের প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। যাদের একটি বড় অংশ অন্যের কথা শুনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। গুজবের ওপর নির্ভর করে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করে। তারা শেয়ারবাজারের আচরণ, বিনিয়োগের ব্যাপারে সঠিক মনোভাব, সফল বিনিয়োগকারী হওয়ার জন্য কী করা উচিত, আর কী করা উচিত নয়—এসব বিষয় সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই বললেই চলে। ফলে বাজারে যখন ধস নামে তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।   

তাহলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবেন কার বুদ্ধিতে? বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একটি বিও একাউন্ট খুলে যত সহজেই একটি কোম্পানির শেয়ার কেনা যায়, তত সহজেই বিনিয়োগকারী হওয়া যায় না। আপনি কখনো কখনো হয়তো একটি কোম্পানির শেয়ার কিনে তাত্ক্ষণিকভাবে কিছুটা লাভবান হতে পারেন কিন্তু কখনোই দীর্ঘ মেয়াদে আপনি ভালো করবেন না। আপনাকে জেনেবুঝেই এই বাজারে আসতে হবে। পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের বিনিয়োগকারীরা পড়াশুনা করতে চায় না। শিখতে চায় না, জানতে চায় না। কিন্তু না শিখলে কীভাবে তারা বিনিয়োগকারী হবে? নিজেকে একজন সফল বিনিয়োগকারী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কী কী শিখতে হবে এ প্রশ্নে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘আপনাকে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এই জ্ঞানের মাধ্যমেই সঠিক বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। সেই সঙ্গে বিনিয়োগ কৌশলতো রয়েছেই? এসবই আপনাকে আয়ত্ব করতে হবে। প্রতিনিয়ত শেখা আর জানার আগ্রহই একজন বিনিয়োগকারীর দূরদৃষ্টিকে শাণিত করবে।’ 

বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগগুরু ওয়ারেন বাফেটের সঙ্গে সাধারণ বিনিয়োগকারীর পার্থক্য হলো, ওয়ারেন বাফেট নিজেকে প্রস্তুত করে, অনেক হিসেবনিকেশ করে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় এগোন, চ্যালেঞ্জ নেন। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রস্তুতি ছাড়াই চ্যালেঞ্জ নেন। 

কোখায় শিখবেন? দেশে-বিদেশে পুঁজিবাজার নিয়ে পড়াশুনার জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, ইনস্টিটিউট আছে। দেশে ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) পুঁজিবাজার নিয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা আছে, মাস্টার্স আছে। এছাড়া পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জসহ (সিএসই) বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজার নিয়ে বিভিন্ন কোর্স করায়। এছাড়া ইন্টানেটে রয়েছে হাজারো টিউটোরিয়াল আর গবেষণাধর্মী নিবন্ধ। কেউ সেখানে অংশ নিয়ে পুঁজিবাজার সম্পর্কে জানতে ও শিখতে পারবে।  

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তালিকাভুক্ত কোম্পানির ব্যবসা বিশ্লেষণের সক্ষমতা। এজন্য কোম্পানির হিসাব প্রতিবেদন, কোম্পানির ব্যবসার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত্ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। এছাড়া কোম্পানির বিক্রি, মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি লভ্যাংশ প্রদানে কতটা সক্ষম তাও বিশ্লেষণ করা জানতে হবে। এতে কোম্পানির শেয়ারের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা যায়। এছাড়া আরো নানা বিশ্লেষণ রয়েছে। এর মধ্যে মূল্য আয় (পিই) অনুপাত, বাজারদর ও সম্পদমূল্যের অনুপাত (পিবি), পরিচালন ও নিট মুনাফার মার্জিন এবং পিই ও ইপিএস প্রবৃদ্ধির (পিইজি) অনুপাত অন্যতম। রয়েছে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসও। যার মধ্যে নিয়ে একজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। শেয়ারবাজারের জন্য অর্থবাজার বা মানি মার্কেটও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। সুদের হার, ঋণের চাহিদা ও সরবরাহ তথা তারল্য পরিস্থিতি শেয়ারবাজারের সার্বিক মূল্যস্তরকে প্রভাবিত করে। বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীরা সম্ভাবনাময়, বর্ধনশীল ইন্ডাস্ট্রির ভালো কোম্পানি শেয়ারের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়। কারণ, এসব শেয়ার দীর্ঘমেয়াদে বেশি রিটার্ন দেয়। 

তবে নানা বিচার-বিশ্লেষণ করে শেয়ার কেনার পরও বিনিয়োগকারীর আচরণভেদে রিটার্নও ভিন্ন হয়ে থাকে। এ নিয়ে বেশকিছু এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে ওয়াল স্ট্রিটে।  মৌলভিত্তি ও বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণের একই ধরনের প্রশিক্ষণ ও উপকরণ দিয়ে ওয়াল স্ট্রিটের একদল বিনিয়োগকারীকে মাঠে ছেড়ে দেওয়া হলো। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় শেষে দেখা যায়, নিজ ব্যক্তিত্ব ও মনস্তাত্ত্বিক রেসপন্সের কারণে বিনিয়োগকারীরা ভিন্ন ভিন্ন ফল দেখিয়েছেন। বাজারে সক্রিয় বিভিন্ন ক্যাটাগরির বিনিয়োগকারী ও তাদের কর্মকৌশল সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলে শেয়ারবাজারের আচরণ অনুধাবন আরো সহজ হয়। তবে শেয়ারবাজারে সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, কৌশল ও শৃঙ্খলার বিকল্প নেই।

ইত্তেফাক/এএইচপি